হেতমপুর রাজবাড়ির দুর্গাপ্রতিমা। নিজস্ব চিত্র
রাজাদের রাজপাট কিংবা রাজবাড়ির জৌলুস হারিয়েছে কবেই। তার পরেও পারিবারিক ঐতিহ্যকে ‘ম্লান’ হতে দিতে চান না হেতমুরের রাজকন্যা বৈশাখী চক্রবর্তী। রথের পরে এ বার তাই শতাব্দী প্রাচীন পারিবারিক উৎসব দুর্গাপুজোর পুরনো মেজাজ ফিরিয়ে আনতে তিনি মরিয়া। সেই অনুয়ায়ী প্রস্ততি চূড়ান্ত। রাজবাড়ির প্রাচীন দুর্গামণ্ডপে প্রতিমা গড়া সম্পন্ন। এ ছাড়া মণ্ডপের সামনেটা বাঁশ কাপড় দিয়ে ঘিরে তৈরি হয়েছে। সাজছে আলোয়। আজ মহাষষ্ঠীতে প্রয়াত রাজা মাধবীরঞ্জন চক্রবর্তীর স্ত্রী, রানি পূর্ণিমা চক্রবর্তী রাজপরিবারের দুর্গাপুজোর উদ্বোধন করবেন।
রাজবাড়ির পুজোর সেই সোনালি অতীত হয়তো ফিরবে না। তবুও বৈশাখীদেবী চাইছেন, ১৮৫ তম বর্ষে কিছুটা হলেও হেতমপুর রাজবাড়ির পুজোর জাঁক মানুষ অনুভব করুন। যা গত দু’দশকে ফিকে হয়ে পড়েছিল। বৈশাখীদেবীর কথায়, ‘‘রাজপরিবার পুজোর খরচ চালালেও, প্রাক্তন কর্মীদের গাফিলতিতে সর্বজনীন হয়ে গিয়েছিল। এলাকার বর্তমান প্রজন্ম জানতই না, এটা রাজপরিবারের পুজো, যা অতীতে ‘মুনসেফ ঠাকুরাণী’র পুজো বলে এলাকায় পরিচিত ছিল। সর্বজনীন হোক, গ্রামের প্রত্যেক মানুষ আনন্দ করুন নিশ্চয়ই চাই। কিন্তু সঙ্গে ইতিহাসটাও থাকুক।’’
ইতিহাস বলছে, সময়টা বাংলা ১২৪০ সাল। হেতমপুর রাজাদের বৈভব তখন আলাদা। গৌরাঙ্গ মন্দির, রাধাবল্লভ মন্দির থাকলেও তখন দুর্গাপুজো ছিল না। বর্তমান প্রজন্মের ছ’পুরুষ গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তীর ইচ্ছে হয় রাজবাড়িতেই মায়ের পুজো করতে হবে। কিন্তু তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে তাঁর বাবা রাজা রাধানাথ চক্রবর্তী ছেলের ইচ্ছে রাখতে দুর্গাপুজো করার সিদ্ধান্ত নেন। তড়িঘড়ি একচালা মণ্ডপ বানিয়ে তাঁর বিবাহিত মেয়ে রুক্মিণী দেবীর নামে পুজোর সঙ্কল্প করেন। রুক্মিণী দেবীর স্বামী দ্বারকানাথ মুখোপাধ্যায় মুনসেফ ছিলেন বলে, পুজোর পরিচিতি হয়ে যায় ‘মুনসেফ ঠাকুরাণী’র পুজো বলে।
রাজার আমলে পুজোর আয়োজনও ছিল রাজকীয়। পুজো চার দিন ধরে চলত, টপ্পা, পুতুল নাচ, যাত্রান। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে গ্রামের মানুষ পাত পেরে প্রসাদ খেতেন। হেতমপুর গ্রামের প্রবীণ সাতকড়ি ঠাকুর বলছেন, ‘‘আমাদের ছেলেবেলায়ও সেই বৈভব দেখেছি। রাজারা খরচ চালালেও নাজিরাই দেখভাল করতেন পুজোর। ক্রমশ সে সব অতীত হয়ে যায়। এক সময় এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, গ্রামের মানুষ চাঁদা করে পুজো চালাচ্ছিলেন।’’ বৈশাখীদেবী বললেন, ‘‘অবস্থা খারাপ হয়েছিল ঠিকই। তবে, বরাবর খরচ দিলেও রাজপরিবারের করুণ অবস্থাটা আরও বেশি করে তৈরি করেছিলেন বাবার আমলে রাজপরিবারের কিছু কাজের লোক। আমার আপত্তি সেখানেই।’’
উল্লেখ করা যায়, রাজাদের প্রাচীন গৌরাঙ্গ মন্দির থেকেই ফি বছর বের হতো হেতমপুর রাজাদের শতাব্দী প্রাচীন ইংল্যান্ডে তৈরি পিতলের পাঁচ চূড়া রথ। ২০০৭ সালে বর্তমানে গৌরাঙ্গ মন্দিরের দেখভালের দায়িত্বে থাকা গৌড়ীয় মঠ গৌরাঙ্গ বিগ্রহ চাপাতেন না বলে সংঘাত বাধে রাজকন্যার সঙ্গে। বৈশাখী দেবী গৌরাঙ্গ নিত্যানন্দের বিগ্রহ তৈরি করিয়ে এ বার রাজবাড়ি থেকে রথ বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত রথ গৌরাঙ্গ মন্দির ছুঁয়ে গেলেও রাজকন্যা নিজের অবস্থান থেকে সরেননি। পারিবারিক দুর্গাপুজোর পুরনো মেজাজ ফেরাতে একই রকম মরিয়া তিনি। এবং সেটা গাঁটের কড়ি খরচ করেই। ‘‘যা করছি কষ্ট করেই’’—বলছেন রাজকন্যা।
রীতি মেনে পুজোর আয়োজনের পাশাপাশি পুজোর তিন দিন গ্রামের মানুষকে ভোগ খাওয়ানোর ব্যবস্থাও পাকা। ঠিক হয়েছে, পুজোর তিন দিন বাসন্তী পোলাও, ঘি-ভাত ও খিচুড়ি ভোগ থাকবে সকলের জন্য। বৈষ্ণব মতে পুজো হয় বলে রাজবাড়িতে কোনও ছাগ বলি দেওয়া হয় না। দেওয়া হয় ছানার মন্ডা বলি। সপ্তমীর দিন ১ কেজি ওজনের মন্ডা, অষ্টমীতে ২ কেজির এবং নবমীর দিন আবার ১ কেজি ওজনের মন্ডা বলি। বাজনা-আলো-ঝাড়বাতি সবই থাকছে। তবে গ্রামের এক জনের মৃত্যু হওয়ায় যাত্রাপালা ও মাইক বন্ধ।
হেতমপুরের মানুষজন বলছেন, ‘‘এমনিতেই গ্রামে পুজোর সংখ্যা বারো। রাজবাড়ির পুজোয় জাঁক হলে আরও আনন্দ হবে।’’