কুস্তাউরে লাইন পরীক্ষা চলছে, কোটশিলায় তখনও ওঠেনি অবরোধ। ছবি: সুজিত মাহাতো ও দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়।
আন্দোলন ঘিরে একদিকে প্রশাসনের ‘উদাসীনতা’ আদিবাসী কুড়মি সমাজের নেতৃত্বের উপরে চাপ বাড়াচ্ছিল। অন্যদিকে, বুধবার থেকে কুস্তাউরে পুরুলিয়া-চান্ডিল রেলপথ এবং রাজ্য সড়ক টানা অবরুদ্ধ থাকায় একই ভাবে চাপ বাড়ছিল প্রশাসনের অন্দরেও। এমনই দাবি করছেন ওয়াকিবহাল মহল। তাঁদের মতে, ওই পরিস্থিতিতে শনিবার পুরুলিয়ায় সকালে এক দফা এবং পরে রাতভর বৈঠকে দু’পক্ষের স্নায়ু যুদ্ধ চলে। তাতেও মীমাংসা হয়নি। শেষে রবিবার সকালে কুস্তাউর স্টেশনে জলকামান নিয়ে পুলিশ বাহিনীও মোতায়েন করা হয়। পরে বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ কুস্তাউর থেকে অবরোধ সরিয়ে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন আদিবাসী কুড়মি সমাজের মূল মানতা অজিত মাহাতো। যদিও তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পূর্ব ঘোষণা মতো পুরুলিয়া-মুরী শাখার কোটশিলা স্টেশনে এবং লাগোয়া রাজ্য সড়কের উপরে আবরোধ শুরু করে দেয় আদিবাসী কুড়মি সমাজ। জেলা শাসক রজত নন্দা জানিয়েছেন, রাত ৮টা নাগাদ কোটশিলা থেকেও অবরোধ তোলা হয়েছে।
এ দিন সকালে অজিত অভিযোগ করেন, ‘‘আদিবাসী কুড়মি সমাজ প্রশাসনিক অত্যাচারের শিকার। জাতিসত্তার এই আন্দোলনে আমরা পাঁচ দিন ধরে এখানে কষ্ট করে রোদের মধ্যে পড়ে রয়েছি। অথচ প্রশাসনের তরফে কোনও সহানুভূতি দেখানো হয়নি। শনিবার রাতে বৈঠক করে আমাদের নানা ভাবে চাপ দেওয়া হয়েছে। একটাই কথা, ‘আন্দোলন তুলতে হবে’। এটা চাপ নয়? আমরা তো স্টেশন অবরোধ করে পড়ে থাকতে এখানে আসিনি। সংবিধানে একটি জাতিসত্তার জন্য যা বলা রয়েছে সেই অধিকারের দাবিতেই আমাদের লড়াই। আজ যদি বৈঠক করে আমাদের হাতে সেই চিঠি তুলে দেওয়া হত, মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতাম।’’ তিনি জানান, তাঁদের কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী ২০ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডে তাঁরা অবরোধ করবেন।
শনিবার রাতে কয়েক দফায় পুরুলিয়া অতিরিক্ত জেলাশাসকের (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) কার্যালয়ে জেলাশাসক রজত নন্দা, পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ আধিকারিকেরা আদিবাসী কুড়মি সমাজের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। জেলাশাসক রজত নন্দা বলেন, ‘‘শনিবার রাতে আন্দোলনকারী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক হয়। মানুষের দুর্ভোগের কথা মাথায় রেখে আমরা তাঁদের অবরোধ তুলে নিতে বলেছিলাম। আলোচনার পরে তাঁরা অবরোধ তুলে নিয়েছেন।’’ চাপ দেওয়ার অভিযোগ মানেননি জেলাশাসক। তিনি বলেন, ‘‘তাঁরা চাইলে আগামী সোমবার মুখ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। জেলা প্রশাসনই সে ব্যবস্থা করবে। এই মর্মে একটি চিঠিও তাঁদের দেওয়া হয়েছে।’’ যদিও অজিত বলেন, ‘‘ওই চিঠি আমরা গ্রহণ করিনি। সে প্রশ্নও নেই। সেই তো আলোচনার জন্য চিঠি। এ রকম আলোচনা একাধিকবার হয়েছে। লাভ হয়নি।’’
প্রশাসনের পাল্টা দাবি, অবরোধ শুরুর আগে রেল ও তাদের তরফে অজিতদের কর্মসূচি প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েও লাভ হয়নি। বুধবার থেকে আন্দোলন শুরুর পরে শনিবার বেলার দিকে প্রথমবার জেলা প্রশাসন সংগঠনের মূল মানতার সঙ্গে বৈঠকে বসে। অবরোধ প্রত্যাহার করলে সোমবার তাঁদের সঙ্গে রাজ্যের মুখ্য সচিবের বৈঠকের ব্যবস্থা করা হবে বলেও জেলা প্রশাসন জানায়। অজিত জানিয়ে দেন, কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি মতো রাজ্য সরকার আগে ফারদার জাস্টিস কমেন্ট পাঠাবে। তাঁরা তা দেখবেন। তারপরেই আন্দোলন প্রত্যাহারের কথা ভাববেন।
সূত্রের খবর, প্রশাসন অবশ্য শনিবার বিকেলেই অবরোধ তোলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ভারী সংখ্যায় পুলিশ পৌঁছয় কুস্তাউরে। সূত্রের খবর, কুস্তাউর ও খেমাশুলি স্টেশনে অবরোধ তুলতে প্রশাসন যাতে ব্যবস্থা নেয়, সে কথা জানিয়ে শনিবার দক্ষিণ-পূর্ব রেলের অ্যাডিশনাল জেনারেল ম্যানেজার অতুল্য সিংহ নবান্নকে চিঠি দেন। তিনি জানান, অবরোধ না উঠলে রাজ্য পুলিশ ও জিআরপিকে দিয়ে অবরোধ তোলানো হোক। আরপিএফ এবং রেল প্রশাসন সর্বত ভাবে সাহায্য করবে। সেই চিঠি আসার পরেই জেলা প্রশাসন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে শনিবার রাতে আলোচনায় বসে বলে সূত্রের দাবি। সেখানেই আন্দোলনকারীদের উপরে প্রশাসনের তরফে চাপ দেওয়ার হয় বলে অভিযোগ। সূত্রের খবর। দফায় দফায় আলোচনা চলার পরেও দু’পক্ষই অনড় থাকেন। রবিবার ভোরের দিকে অজিত বৈঠক থেকে বেরিয়ে যান। এরপরেই কুস্তাউর স্টেশনে ঝাঁকে ঝাঁকে পুলিশ কর্মী মোতায়েন হয়। আরপিএফ-এর সংখ্যাও ভারী ছিল। তবে তাঁরা দূরত্ব রেখেই পরিস্থিতির উপরে নজর রাখছিল। পরে বেলা বাড়লে সেখান থেকে অবরোধ তোলার কথা ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু দুপুর প্রায় ১২টা থেকে অবরোধ শুরু হয় পুরুলিয়া-মুরী শাখার (পুরুলিয়া-রাঁচী রেলপথ) কোটশিলা স্টেশনে। পাশাপাশি চাষমোড়-তুলিন (পুরুলিয়া-রাঁচী রাস্তা) রাজ্য সড়কও অবরোধ করা হয়। রেললাইনের উপরে বসে পড়েন বহু মানুষ। কুস্তাউরে আন্দোলন প্রত্যাহারের পরে অজিত মাহাতো কোটশিলায় পৌঁছন। সেখানে তিনি বক্তৃতা দেন। পরে রাতে সেখানে অবরোধ তোলা হয়।
কুস্তাউরে টাওয়ার ওয়াগন দিয়ে ওভারহেড তার পরীক্ষা করা হয়। মেটাল ডিটেক্টরের দিয়ে রেললাইনও পরীক্ষা করা হয়। দুপুর প্রায় ১টা নাগাদ পুরুলিয়ার দিক থেকে একটি মালগাড়ি চালানো হয়। রেল জানিয়েছে, পরপর কয়েকটি মালগাড়ি চলাচল করার পরে বিকেলে দু’টি আসানসোল-বরাভূম মেমু প্যাসেঞ্জার এই শাখায় চলাচল করেছে। আজ, সোমবার যে ট্রেনগুলি বাতিল করা হয়েছিল, তার মধ্যে ১০টি ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।