ফাইল চিত্র।
বাঁকুড়া মেডিক্যালে ‘রেফার’ করা বা ছুটি হওয়া রোগীদের জন্য অ্যাম্বুল্যান্স নেই। আর সেই সুযোগেই বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স মালিকেরা রাত নামলেই রোগী নিয়ে যেতে লাগামছাড়া ভাড়া হাঁকছেন বলে অভিযোগ। দীর্ঘদিন ধরে এই সমস্যা চললেও কেন জনপ্রতিনিধিরা বা বাঁকুড়া মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের কথা ভেবে অ্যাম্বুল্যান্স বাড়ানোয় নজর দেননি, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
সোমবার রাতে এক মানসিক ভারসাম্যহীন প্রসূতিকে বাঁকুড়া থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে বড়জোড়ার গ্রামে নিয়ে যেতে বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স চালক ২,৬০০ টাকা ভাড়া নেন বলে সামাজিক মাধ্যমে সরব হন তাঁর সঙ্গীরা। যদিও ওই ঘটনা শুনে তাজ্জব নন অনেকে। কারণ, এমন অভিজ্ঞতা কম লোকের হয়নি।
মাসখানেক আগে ওষুধ খেতে গিয়ে বিষ্ণুপুরের এক প্রবীণ শঙ্খশিল্পীর গলায় নকল দাঁত আটকে যায়। বাঁকুড়া মেডিক্যাল থেকে রাতে তাঁকে কলকাতায় ‘রেফার’ করা হয়। কিন্তু বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া শুনে বিপদে পড়ে যান দুঃস্থ শিল্পীর পরিজনেরা। তাঁর স্ত্রী বন্দনা হাজারির অভিযোগ, “স্বামীর তখন শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাঁকুড়া থেকে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে স্বামীকে নিয়ে যেতে অ্যাম্বুল্যান্স চালক ২০ হাজার টাকা ভাড়া চাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। বুঝেছিলাম, মানুষ বিপদে পড়লেই ওঁদের ব্যবসা খুলে যায়। পরে বিষ্ণুপুর থেকে আট হাজার টাকা ভাড়ায় অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করি।’’ তাঁর দাবি, মানুষের অসহায়তার সুযোগ নেওয়া বন্ধ হোক।
কিন্তু তা কি এত সহজ?
বাঁকুড়া মেডিক্যাল সূত্রের খবর, তাদের তিনটি অ্যাম্বুল্যান্স রয়েছে। কিন্তু সেগুলি ‘রেফার’ করা রোগীদের জন্য নয়। তাতে বাঁকুড়া মেডিক্যালের গোবিন্দনগর ও লোকপুর ক্যাম্পাসের মধ্যে রোগীদের নিয়ে যাওয়া-আসা করা হয়। এ ছাড়া, জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তার বা নার্সদের বাসস্থান থেকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে ব্যবহার করা হয়। ব্লাডব্যাঙ্কের শিবির করতেও ভরসা ওই অ্যাম্বুল্যান্স। এ ছাড়া, হাসপাতালের আনুষঙ্গিক নানা কাজে অ্যাম্বুল্যান্স তিনটি ব্যবহার করা হয়।
রোগীর পরিজনদের বক্তব্য, সরকারি ভাবে হাসপাতালে অ্যাম্বুল্যান্স থাকলে রোগী নিয়ে যেতে ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয় না। তাতে বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স চালকদেরও ভাড়া নিয়ে ‘জোরজুলুম’ বন্ধ হত।
যদিও বাঁকুড়া মেডিক্যালের অধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম প্রধান দাবি করেন, ‘‘কোনও হাসপাতালেই রোগীদের জন্য অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা থাকে না। জনপ্রতিনিধিরা অ্যাম্বুল্যান্স দিলে, তার রক্ষণাবেক্ষণের খরচেরও ব্যবস্থা করতে হয়। কোনও সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছায় তা করতে আগ্রহী হলে, অ্যাম্বুল্যান্স রাখার জন্য আমরা হাসপাতাল চত্বরে জায়গা করে দেব।’’
বাঁকুড়ার বিজেপি সাংসদ সুভাষ সরকার বলেন, ‘‘আমি অনেক আগেই বাঁকুড়া মেডিক্যালে অ্যাম্বুল্যান্স দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম। তবে রক্ষণাবেক্ষণ কে করবে, তা নিয়ে সমস্যা হওয়ায়, অ্যাম্বুল্যান্স দিতে পারিনি। তবে মেডিক্যালের অ্যাম্বুল্যান্স নেই বলে, ব্যক্তিগত অ্যাম্বুল্যান্স চালকেরা যা খুশি ভাড়া হাঁকবেন, তা চলতে পারে না।’’
বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার জন্য নানা কাজ করে যাচ্ছে। তাদের অ্যাম্বুল্যান্সের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিলে নিশ্চয় অনেকে রাজি হবেন বলে মনে করছেন অনেকে। বড়জোড়ার ওই প্রসূতির সঙ্গী হারাধন কর্মকারের দাবি, “হাসপাতাল চত্বরে রাতে প্রসূতিদের জন্য সরকারি প্রকল্পের অ্যাম্বুল্যান্স থাকার কথা থাকলেও সোমবার রাতে আমরা পাইনি। জনপ্রতিনিধি তহবিল থেকে কিনে দেওয়া অ্যাম্বুল্যান্স থাকলেও ভোগান্তি কমত। মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ আগ্রহী হলে, নিশ্চয় অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এগিয়ে আসবেন।’’
অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে ‘গোবিন্দনগর ট্যাক্সি ওনার্স অ্যান্ড ড্রাইভার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক বুলবুল সর্দারের দাবি, “কোনও গাড়ির চালক রোগীদের কাছে বেশি ভাড়া দাবি করলে তা সংগঠনের নিয়ম বিরুদ্ধ। ওই চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।” তিনি জানান, অ্যাম্বুল্যান্স, শববাহী গাড়ি ও ছোট গাড়ির ভাড়া নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। তার বেশি ভাড়া নেওয়া যাবে না বলেও চালকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মেডিক্যালে ‘রেফার’ রোগীদের জন্য না হয় অ্যাম্বুল্যান্স নেই, কিন্তু বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়ার বিষয়েও তো প্রশাসন নজর দিতে পারে?— প্রশ্ন রোগীর পরিজনদের।
বাঁকুড়া মেডিক্যালের রোগীকল্যাণ সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান তথা বাঁকুড়া কেন্দ্রের বিধায়ক শম্পা দরিপা বলেন, “রোগীরা বিপাকে পড়লে সেই সুযোগে তাঁদের থেকে বাড়তি ভাড়া চাওয়া গুরুতর অপরাধ। শীঘ্রই গাড়ি চালকদের সংগঠনের সঙ্গে আলোচনায় বসে অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া বেঁধে দেওয়া হবে। তার বাইরে কেউ ভাড়া চাইলে, কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’