বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজবংশের কুলদেবী মৃন্ময়ীর পুজো। নিজস্ব চিত্র।
সকালে মেঘে ঢাকা আকাশের ফাঁক গলে সবেমাত্র সূর্য উঁকি দিয়েছে পুব আকাশে। মুর্ছা পাহাড় থেকে পর পর ভেসে এল তোপধ্বনি। ঢোল আর সানাইয়ের মিলিত নহবতের শব্দে মল্ল কূলদেবী মৃন্ময়ীর মন্দিরে পা রাখলেন ‘বড় ঠাকরুন’ অর্থাৎ মহাকালী। ১,০২৬ বছরের প্রাচীন রীতি মেনে পুজো শুরুর ১০ দিন আগেই বিষ্ণুপুরের মল্ল কূলদেবীর মন্দিরে মহা সমারোহে শুরু হয়ে গেল দুর্গাপুজা। কামানের নির্ঘোষ মল্লভূম জুড়ে ঘোষণা করল আগমনী বার্তা।
এ রাজ্যের প্রাচীন পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজবংশের কুলদেবী মৃন্ময়ীর পুজো। রাজপরিবারের বংশধরদের দাবি, চলতি বছর এই পুজো পা রাখল ১,০২৬ বছরে। এক সময় মল্ল রাজাদের রাজধানী ছিল বাঁকুড়ারই জয়পুর ব্লকের প্রদ্যুম্নপুর গড়ে। জনশ্রুতি, ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের কোনও এক সময় তৎকালীন মল্লরাজা জগৎমল্ল শিকারে বেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন তৎকালীন ঘন জঙ্গলে ঢাকা বিষ্ণুপুরে। একটি বটগাছের ছায়ায় ক্লান্ত ও অবসন্ন জগৎমল্ল ঘুমিয়ে পড়েন। এই সময় বিভিন্ন অলৌকিক কর্মকান্ডের সাক্ষী হন তিনি।
কথিত আছে সেই সময়েই দেবী মৃন্ময়ী রাজার সামনে আবির্ভূত হয়ে বটগাছের পাশে মন্দির প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি, রাজধানী প্রদ্যুম্নপুর থেকে বিষ্ণুপুরে স্থানান্তরের নির্দেশও দেন দেবী। সেই নির্দেশ মেনে রাজা জগৎমল্ল জঙ্গল কেটে বিষ্ণুপুরের সেই স্থানে প্রতিষ্ঠা করেন মৃন্ময়ী মন্দির। পাশেই তৈরি করেন রাজপ্রাসাদ। প্রদ্যুম্নপুর থেকে রাজধানী সরিয়ে আনা হয় বিষ্ণুপুরে। রাজ কুলদেবী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত মৃন্ময়ীর মন্দিরে শুরু হয় দুর্গাপুজা। প্রথমে কয়েকবছর ঘটেপটে পুজা হলেও পরে গঙ্গামাটি দিয়ে দেবীমুর্তি তৈরী করে মন্দিরে শুরু হয় পুজো।
এক সময় মল্ল রাজারা শাক্ত ছিলেন। ফলে দেবীর পুজো হত তন্ত্র মতে। সে সময় নাকি হত নরবলিও! ষোড়শ শতকে রাজা বীর হাম্বির শ্রীনিবাস আচার্যর সান্নিধ্যে এসে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। বৈষ্ণব ধর্মকে মল্ল রাজত্বে ‘রাজধর্ম’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই নরবলি বন্ধ হয়। শুরু হয় সঙ্গীতের অষ্টরাগে দেবী আরাধনা । রাজ বাড়ির ‘বলী নারায়ণী পুঁথি’ অনুসারে, দেবীর পুজো হয়ে আসছে গোড়া থেকেই। স্বাভাবিক ভাবেই এই পুজোর নিয়ম কানুন সবই আলাদা। জীতাষ্টমীর পরের দিন নবমী তিথিতে এখানে স্থানীয় গোপাল সায়ের নামের একটি পুকুরে মহাকালীর পটে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তা আনা হয় মৃন্ময়ীর মন্দিরে। এরপর মান চতুর্থীর দিন মন্দিরে আনা হয় মেজ ঠাকুরানি ও সপ্তমীর দিন মন্দিরে আনা হয় ছোট ঠাকুরানিকে। এই তিন ঠাকুরানি আসলে দেবীর তিন বৈষ্ণবী রূপ মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহা সরস্বতী।
রীতি মেনে মঙ্গলবার সকালে বড় ঠাকুরানিকে স্থানীয় গোপাল সায়ের নামের একটি পুকুরের ঘাটে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে মৃন্ময়ী মন্দিরে আনার মধ্য দিয়ে মল্লভূম জুড়ে সূচিত হয়ে গেল দুর্গাপুজা। স্থানীয় মুর্ছা পাহাড় থেকে মুহুর্মুহু কামানের শব্দে কেঁপে উঠল গোটা মল্লভূম। একসময় মৃন্ময়ীর পুজোকে ঘিরে যে জাঁকজমক ছিল রাজন্যপ্রথা বিলোপের পর তা আজ অনেকটাই ম্লান। কিন্তু এখনও কৃষ্ণা নবমী তিথিতে মুর্ছা পাহাড় থেকে তোপধ্বনির পর আনন্দে মেতে ওঠেন আপামর মল্লভূমবাসী।
রাজ পরিবারের সদস্য জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ ঠাকুর বলেন, ‘‘রাজত্ব না থাকায় পুজোর জাঁকজমক কমেছে। কিন্তু পুজোর নিয়ম, নিষ্ঠা ও আচারে বিন্দুমাত্র এদিক-ওদিক হয়নি। এই পুজো শুধু রাজবাড়ির পুজো নয়, এটি গোটা মল্লভূমের পুজো। মল্লভূমের বিশাল এলাকা জুড়ে থাকা হাজার হাজার মানুষের কাছে এই পুজো একটি আবেগের নাম।’’ রাজ পুরোহিত তরুণ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বলী নারায়ণী পুঁথি, রাজ পরিবারের নিজস্ব পুঁথি। এই পুঁথি অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এই পুঁথি অনুসারে আর কোথাও দুর্গাপুজোও হয় না। স্বাভাবিক ভাবে রাজ কূলদেবী মৃন্ময়ীর পুজোর তন্ত্র-মন্ত্র, তিথি-নক্ষত্র গণনা, সবই আলাদা।’’