দালাল পরিবারে হর-পার্বতীর পুজো।— তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়
ঘরের মেয়ের বিদায়বেলায় সকলের মনে যখন বিষাদের সুর চওড়া হচ্ছে, ঠিক তখনই উল্টো ছবি দেখা গেল সিউড়ির কড়িধ্যায়। বিদায় কোথায়? কড়িধ্যার দাস দালাল পরিবার তখন চরম ব্যস্ত মা-কে বরণ করে ঘরে তোলার আনন্দে!
বাপের বাড়ি ছেড়ে ঘরের উমা শ্বশুর বাড়িতে ফিরছেন— এই ভাবনা থেকেই হর-পার্বতীর পুজোর শুরু এই পরিবারে। একাদশী থেকে ত্রয়োদশী পর্যন্ত পুজোর পর হয় বিসর্জন। গত ১২২ বছর ধরে যে এটাই রীতি,.জানাচ্ছেন পরিবারের সদস্যেরা।
দাস দালালদের পারিবারিক ইতিহাস বলছে, শিব-পার্বতী পুজোর সূচনা হয়েছিল চার পুরুষ আগে। পেশায় বস্ত্র ব্যবসায়ী রামচন্দ্র দাসের আমলে। কলকাতা থেকে কাপড় এনে কড়িধ্যায় ব্যবসা চালাতেন তিনি। তা থেকেই ব্রিটিশরা রামচন্দ্রের দাস পদবির সঙ্গে একটি উপাধি ‘দালাল’ জুড়ে দিয়েছিল। সেই রামচন্দ্রই স্বপ্নে দেখেছিলেন মা ফের পুজো চান। তারপরই বাংলার ১৩০২ সালে পুজোর প্রচলন হয়। রামচন্দ্রের পর ছেলে নিত্যগোপাল পুজোর দায়িত্ব নেন। ক্রমশ নিত্যগোপালের তিন ছেলে নারায়ণ, রাধাশ্যাম ও তারাশঙ্কর দাস দালালদের হাতে পুজো হতে থাকে। নারায়ণবাবুদের অবর্তমানে, পুজোর দায়িত্বে সামলাচ্ছেন তাঁদের সন্তানেরা। পেশাগত কারণে বিভিন্ন জায়গায় থাকলেও বছরের এই ক’টা দিনে সকলেই উপস্থিত হন কড়িধ্যায়।
নারায়ণ দাস দালালের দুই ছেলে তুষারকান্তি, তাপসকান্তি বা তারাশঙ্কর দাস দালালের বড় ছেলে দেবব্রতরা একসুরে জানাচ্ছেন, পুজো ভীষণ আন্তরিকতা ও আনন্দের সঙ্গে চলে। কিন্তু, কেন এই উলটপুরাণ?
পরিবারের সদস্যদের অনুমান, দশমীর শেষের মন খারাপটা জুড়ে গিয়েছিল পূর্বপুরুষ তথা পুজোর প্রচলক রামচন্দ্রের স্বপ্নের সঙ্গে। তাই আনন্দের কালটা আরও ক’টা দিন বাড়িয়ে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। তেমনটা করার পরে ব্যবসায় সমৃদ্ধি আসায় আর বন্ধ হয়নি পুজো।
দশমীর দিন সকালে সমস্ত মণ্ডপে যখন সিঁদুর খেলা, মিষ্টিমুখের মধ্যে দিয়ে বিসর্জনের ক্ষণ এগিয়ে আসছে ঠিক তখন কড়িধ্যা ডাঙালপাড়ায় দাস দালালদের পারিবারিক মন্দিরে পৌঁছে গিয়েছে মূর্তি। চলছে বরণপর্ব। ষাড়ের পিঠে অধিষ্ঠিত দেবী পার্বতী ও মহাদেব। সঙ্গে দুই সহচরী জয়া ও বিজয়া। বধূ মৌ দাস দলাল, চম্পা দাস দালালরা বলছেন, ‘‘পুজোর সময় খুব আনন্দ হয়। এই সময়টার জন্যে মুখিয়ে থাকি। কত লোকজন আসেন। একাদশীতে ধুমটা বেশি। এ দিন ভোগ খাওয়ানোর রীতি চালু আছে।’’ পুজোর জন্যে সারা বছরের অপেক্ষার কথাটা জানাতে ভোলেনি পরিবারের নতুন প্রজন্ম স্কুল পড়ুয়া নীলব্রত, কলেজ পড়ুয়া অন্বেষারাও।
পরিবারের সবচেয়ে বর্ষিয়ান সদস্যা প্রয়াত তারাশঙ্করের স্ত্রী সুমিত্রা দাস দালাল বললেন, ‘‘দুর্গাপুজোর দশমীর দিন আমাদের মন খারাপের নয়, আনন্দের সময়। ওই সময়ে মা বাড়িতে আসেন যে। হৈ চৈ, খাওয়া-দাওয়া আর আনন্দ—গত কয়েক দশক ধরে তো এটাই দেখছি।’’