ঘটনাস্থল: পড়ে আছে ছাতা, মাস্ক। বুধবার দুবরাজপুরের সারদাপল্লিতে। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত
মুষলধারে বৃষ্টি, সঙ্গে লোডশেডিং। তার মধ্যেই বছর আটেকের অসুস্থ ছেলেকে ডাক্তার দেখিয়ে ফিরছিলেন বাবা। বাড়ি ঢোকার ঠিক আগের বাঁকে রাস্তা ঘেঁষে থাকা পাঁচিলটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল তাঁদের দু’জনের উপরে। মারাত্মক জখম অবস্থায় তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রতিবেশীরা। কিন্তু বাবা-ছেলে কাউকেই বাঁচানো যায়নি।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে নটা নাগাদ ঘটনাটি ঘটেছে দুবরাজপুর শহরের চার নম্বর ওয়ার্ডের সারদাপল্লিতে। পুলিশ জানিয়েছে, মৃত্যু হয়েছে সৌরভ মণ্ডল (৪০) এবং তাঁর ছেলে অনীকের। স্বামী ও ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছেন বনলতা মণ্ডল। এই ঘটনায় পরিবার তো বটেই, শোকের ছায়া নেমেছে গোটা পাড়ায়।
প্রায় ৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের যে পাঁচিলের নীচে চাপা পড়ে মারা গিয়েছেন বাবা-ছেলে, সেটি দুবরাজপুর রামকৃষ্ণ আশ্রম পরিচালিত অভেদানন্দ সেবামঙ্গল হাসপাতালের সীমানা প্রাচীর। দুবরাজপুর রামকৃষ্ণ আশ্রমের শীর্ষসেবক সত্যশিবানন্দ বলেন, ‘‘এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা।’’
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, সৌরভ জীবনবিমার এজেন্ট ছিলেন। আদতে পশ্চিম বর্ধমানের ফরিদপুর (লাউদোহা) থানা এলাকার নয়া কাঞ্চনপুরের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। স্ত্রী বনলতা খয়রাশোলের জামরান্দ গ্রামের মেয়ে। তিনি রাজনগরের মুক্তিপুর আশুতোষ উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলা শিক্ষিকা। উভয়ের কর্মস্থলে যাতায়াতে সুবিধার জন্য বছর সাত-আট আগে দুবরাজপুরের সারদাপল্লিতে বাড়ি করে থাকতে শুরু করেন তাঁরা। একমাত্র সন্তান অনীক দুবরাজপুরের একটি বেসরকারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত। সব ঠিকঠাক চলছিল।
মঙ্গলবার রাতে এক লহমায় সব শেষ!
সৌরভবাবুর তুতো বোন সুলেখা ঘোষ বলেন, ‘‘অনীক অসুস্থ ছিল। কাশছিল। তাই দাদা ওকে রাত সওয়া ৮টা নাগাদ স্থানীয় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তার পরেই বৃষ্টি শুরু হয়। অপেক্ষা না করে অন্ধকারেই ফিরছিল। এমনটা হবে কে জানত?’’
বনলতার আক্ষেপ, ‘‘বাড়ি আসতে যদি সামান্য কয়েকে সেকেন্ডের হেরফের হত তাহলে আমার সব শেষ হয়ে যেত না।’’
মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটা থেকে টানা দু’ঘণ্টা মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে দুবরাজপুরে। স্থানীয়েরা জানান, বৃষ্টি শুরু হতেই সারদাপল্লিতে লোডশেডিং হয়ে যায়। চারদিকে জল থইথই। এমন সময় বিকট আওয়াজ পান পাড়ার লোকজন। তার পরেই বাচ্চার কান্না শুনতে পেয়ে দোতলার ঘর থেকে রাস্তায় চর্চ ফেলে সারদাপল্লির বাসিন্দা রাকেশ চক্রবর্তী দেখেন, তাঁরই পড়শি অনীক কাঁদছে। তার ও সৌরভের শরীরের উপরেই ভেঙে পড়েছে পাঁচিলটা।
রাকেশের বাবা, পেশায় আইনজীবী বটকৃষ্ণ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘ছেলের চিৎকারে পরিবারের সকলে বাইরে এসে চাঙড় সরানোর চেষ্টা করি। সঙ্গে সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকি।’’ তা শুনে ছুটে আসেন পড়শি পঞ্চানন সেন, তাঁর ছেলে রাজু এবং দুই তরুণ শঙ্কু চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কু চট্টোপাধ্যায়। উদ্ধারের সময়ই সংজ্ঞা ছিল না সৌরভের। অনীক কাঁদছিল।
দু’জনকে উদ্ধার করে দুবরাজপুর গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে মৃত্যু হয় সৌরভের। যাঁরা ওঁদের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের সকলেরই অভিযোগ, এই অবস্থায় কর্তব্যরত চিকিৎসক অনীকের প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুও না করে তাকে সিউড়ি জেলা হাসপাতালে রেফার করে দেন। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মারা যায় শিশুটি। পড়শিদের আক্ষেপ, ‘‘অন্তত জীবনদায়ী ওষুধ বা স্যালাইন যদি দেওয়া হত, তাহলে শিশুটিকে সিউড়ি নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত বাঁচানো যেত।’’
বিডিও ( দুবরাজপুর) অনিরুদ্ধ রায় বুধবার সকালে ঘটনাস্থলে এলে তাঁর কাছেও মৌখিক ভাবে এই অভিযোগ করেন বাসিন্দারা। বিডিও বলছেন, ‘‘মৌখিক অভিযোগ হলেও আমি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’’ এসিএমওএইচ প্রহ্লাদ অধিকারী বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই খোঁজ নেব। তবে অভিযোগ সত্যি হলে খুবই অন্যায় হয়েছে।’’