এই ধরনের খবরের ক্ষেত্রে আসল ছবি প্রকাশে আইনি নিষেধাজ্ঞা থাকে। —প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
শতাংশের বিচারে নাবালিকা প্রসূতিতে রাজ্যের মধ্যে প্রথম দু’টি স্থানে আছে বীরভূমের দুই স্বাস্থ্যজেলা— বীরভূম ও রামপুরহাট। জেলা প্রশাসন ও বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, নানা সরকারি প্রকল্প ও সচেতনতার প্রচারের পরেও বাল্যবিবাহে রাশ টানা সম্ভব না হওয়ার প্রত্যক্ষ ফল হচ্ছে নাবালিকা প্রসূতির সংখ্যা বাড়া। প্রশাসনের সক্রিয়তায় কিছু বাল্যবিবাহ আটকানো গেলেও জেলা জুড়ে যে অনেক বাল্যবিবাহ হচ্ছে তাও তথ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কারণ, বিভিন্ন ব্লকে যে সংখ্যক বাল্যবিবাহ আটকানো গিয়েছে তার থেকে নথিভুক্ত হওয়া নাবালিকা প্রসূতির সংখ্যা অনেক বেশি। সবচেয়ে উদ্বেগজনক, নাবালিকা প্রসূতির তালিকায় রয়েছে ১৫-র কম বয়সী কিশোরীরাও।
জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, গত এপ্রিল থেকে অগস্ট পর্যন্ত রামপুরহাট স্বাস্থ্যজেলায় মোট প্রসূতির ২৩.৮ শতাংশ নাবালিকা। সবচেয়ে করুণ অবস্থা ময়ূরেশ্বর ১ ব্লকে। অন্য দিকে, বীরভূম স্বাস্থ্য জেলায় এই হার ১৯.৫১। সবচেয়ে পিছিয়ে খয়রাশোল ব্লক। সেখানে হার ২৪.৬৮ শতাংশ। গত অর্থবর্ষের তথ্যও একই কথা বলছে। প্রশাসন সূত্রে খবর, এই তথ্যেই প্রমাণ করছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাবালিকা বিয়ের কথা জানতেই পারছে না প্রশাসন।
মহম্মদবাজার ব্লকে ২৩-২৪ অর্থবর্ষে ২,৯৭৭ জন প্রসূতি নাম নথিভুক্ত করিয়েছিলেন। তার মধ্যে ৮৪৩ জন নাবালিকা। এ তালিকায় ১৫ বছরের কমবয়সি কিশোরী আছে ৩৪ জন। এই ব্লকে প্রশাসন নাবালিকা বিয়ে রুখতে পেরেছিল মাত্র একটি। প্রায় কাছাকাছির অবস্থা রামপুরহাট ব্লকের। এখানে গত অর্থবর্ষে মোট নথিভুক্ত প্রসূতির সংখ্যা ছিল ৩,২৫৩ জন। এর মধ্যে ৭০০ জন নাবালিকা। যার মধ্যে ১৫ বছরের কমবয়সি আছে ৩২ জন। এ ব্লকে নাবালিকা বিয়ে আটকানো গিয়েছিল মাত্র ১৩টি।
পিছিয়ে নেই বোলপুর এবং ইলামবাজারের মতো ব্লকগুলি। বোলপুরে গত অর্থবর্ষে ৯৮০ জন নাবালিকা মা হয়েছে। যার মধ্যে তিন জন নাবালিকা মায়ের বয়স ১৫ নীচে। বিয়ে আটকানো গিয়েছিল মাত্র ১৬টি। অন্য দিকে, ইলামবাজারে ৭১৯ জন নাবালিকা মায়ের মধ্যে ২৮ জনের বয়স ১৫ নীচে। প্রশাসনের তরফে এ ব্লকে বাল্যবিবাহ রুখতে পারা গিয়েছিল মাত্র ১০টি। এ তথ্যই উদ্বেগ বাড়িয়েছে জেলা ও স্বাস্থ্য প্রশাসনে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, গত অর্থবর্ষে গোটা জেলায় ১৪৭ জন নাবালিকার বিয়ে আটকানো গিয়েছিল। এ অর্থবর্ষে সংখ্যাটা এখনও পর্যন্ত ১৩২টি। কিন্তু প্রশাসনের নজরের বাইরে অসংখ্য নাবালিকা বিয়ে হয়েছে। ফলে, বাড়ছে অকাল মাতৃ্ত্বের হার। যার প্রভাবে শুধু নাবালিকা মায়ই নয়, ক্ষতির আশঙ্কা থাকে নবজাতকেরও।
জেলা শিশু সুরক্ষা দফতর, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, প্রশাসন ও পুলিশে অভিজ্ঞতা বলছে, অভিভাবকদের অজ্ঞতা, দারিদ্র বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ। তবে নাবালক, নাবালিকাদের মধ্যে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার প্রবণতাও বাড়ছে। সমাজমাধ্যমের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে এর যোগ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। কোভিডের পরে এই সমস্যা আরও বেড়েছে।
সিউড়ি জেলা হাসপাতালের মনরোগ বিশেষজ্ঞ জিষ্ণু ভট্টাচার্য এর নেপথ্যে বয়ঃসন্ধিজনিত সমস্যা কথাই বলছেন। তিনি জানান, ১২ পেরিয়ে গেলেই দেহে প্রজননগত মানসিক এবং স্নায়বিক পরিবর্তন আসে। মস্তিষ্কে নিউরো হরমোন নিঃসৃত হয়। তিনি বলেন, ‘‘ডোপামিন ক্ষরণে কোথাও একটু ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। এই সময়ে যে শিক্ষা পাওয়ার কথা তা হচ্ছে না। অভিভাবকেরাও দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। তার সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে সমাজমাধ্যম যৌন উত্তেজক কনটেন্টের সহজলভ্যতা।’’
তবে জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানান, নাবালিকা বিয়ে রোখার ব্যাপারে আমরা সম্ভাব্য সব দিক থেকে চেষ্টা করছি। সম্প্রতি এ ব্যাপারে প্রশাসনের বৈঠকে সে কথা স্পষ্ট করা হয়েছে।