অপেক্ষা: শামির এই উৎসব কি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দেখা যাবে? —ফাইল চিত্র।
মহম্মদ শামি সেই দিনগুলো স্পষ্ট মনে করতে পারেন। যখন বেঙ্গালুরুর জাতীয় অ্যাকাডেমিতে একটা সিঁড়ি বেয়ে ওঠার ক্ষমতাও ছিল না। অন্যের সাহায্য নিয়ে ধরে-ধরে এগোতেন। তখন কে ভেবেছিল, এই লোকটাই আবার বল হাতে আগের মতো ছুটবেন! আবার উইকেট নেবেন!
বরোদায় বৃহস্পতিবার বিজয় হজারে ট্রফিতে শামির বোলিং হিসাব: ১০-০-৬১-৩। দারুণ আহ্লাদিত হওয়ার মতো কিছু নয়। শামির মানের বোলারের কাছে তো নয়ই। কিন্তু ক্রমশ যেন মেঘলা আকাশ কেটে গিয়ে রোদ্দুর বেরোচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দলে তাঁর প্রত্যাবর্তন মোটামুটি নিশ্চিত। ‘‘উপরওয়ালা চাইলে সব হয়। সব হবে,’’ বৃহস্পতিবার রাতের দিকে বরোদার হোটেল থেকে আনন্দবাজারকে বললেন শামি। যোগ করলেন, ‘‘সব সময় মনে করেছি, যদি কপালে থাকে আবার খেলব, তা হলে ঠিক খেলব। সব সময় খেলাটার প্রতি সৎ থাকতে চেয়েছি। নিজের কর্মের প্রতি সৎ থাকতে চেয়েছি। চেষ্টা করেছি, উত্থান-পতন যেমন চলে চলুক, আমার দিক থেকে যেন চেষ্টার কোনও খামতি না থাকে।’’ গলায় বেশ দার্শনিক সুর। বোঝাই যাচ্ছে, এক বছরের উপর মাঠের বাইরে পড়ে থাকা শুধু ক্রিকেটার শামিকে নয়, ব্যক্তি শামিকেও অনেক ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
এক বছর পরে দেশের জার্সিতে ফেরার পথে। শেষ খেলেছিলেন সেই ১৯ নভেম্বরের অভিশপ্ত আমদাবাদে। কে জানত, জোড়া ধাক্কা এক সঙ্গে অপেক্ষা করে আছে। বিশ্বকাপ জেতা হবে না, সঙ্গে নিজেও পড়ে যাবেন এত বড় চোটের ভুলভুলাইয়ায়। যেখান থেকে বেরনোর রাস্তাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এক বছর লেগে গেল মাঠে ফিরতে। কতটা কঠিন ছিল এই সময়টা? জানতে চাওয়ায় শামি বললেন, ‘‘খেলোয়াড়ের কাছে খেলাটাই তো সব। সেটাই যদি না থাকে, কার ভাল লাগে? আমার কাছে বলই জীবন। বল হাতে না তুলতে পারলে সেই জীবন কী করে উপভোগ করব? জীবন খুব কঠিন হয়ে উঠেছিল, এটুকু বলতে পারি।’’
কী ভাবে নিজেকে চাঙ্গা রাখতেন? ফোনের ও প্রান্তে একেবারেই চুপ থাকতে শোনা গেল না শামিকে। উত্তরটা যেন জিভের গোড়াতেই ছিল। এক নিঃশ্বাসে বলে দিলেন, ‘‘দেশের জার্সি পরে খেলব, এর চেয়ে বড়় অনুপ্রেরণা আর কী লাগবে? কোনও দিনই আর কোনও প্রেরণা আমার দরকার পড়েনি। আমি বেঙ্গালুরুর জাতীয় অ্যাকাডেমিতে রিহ্যাব করতে করতে শুধু ভারতের জার্সিটা দেখতাম। ব্যস, নিজেকে চাঙ্গা করতে আর কিছুর দরকার পড়ত না।’’
আশপাশ থেকে বাংলা দলের সতীর্থদের গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। এখন কি তা হলে ফেরার জন্য তৈরি? প্রিয় দেশের জার্সি গায়ে তোলার অপেক্ষায়? শামি বললেন, ‘‘আমি ভারতীয় দলে ফিরতে পারব কি না, সেটা সময় বলবে। নির্বাচকেরা ঠিক করবেন আমাকে নেবেন কি না। কখন ফিরব, সেটাও তাঁদের হাতে। তবে আমি আশাবাদী মানুষ। আবার ভারতীয় দলের হয়ে খেলব এই আশা, স্বপ্ন নিয়েই তো লেগেপড়ে থেকেছি যাতে মাঠে ফিরতে পারি।’’ বাংলার হয়ে খেলাটাও দারুণ উপভোগ করেছেন বলে জানালেন। ‘‘একটা কথা বলতে চাই। ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলতে বাংলার শিবিরে ফেরাটা আমাকে ফুরফুরে করে দিয়েছে। দারুণ সময় কাটিয়েছি। মনে হচ্ছিল যেন শুরুর সেই দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছি।’’ বাংলার হয়ে মুস্তাক আলি ট্রফিতে খেলেছেন। বিজয় হজারেতে খেললেন। এ দিনই হরিয়ানার কাছে হেরে বিদায় নিল বাংলা। মাঝখানে খুব হাওয়া উঠে যায়, অস্ট্রেলিয়ায় দ্বিতীয় টেস্টের পরে যোগ দিতে পারেন শামি। কিন্তু হাঁটুতে সমস্যা দেখা দেয় নতুন করে। এই অবস্থায় পাঠিয়ে ঝুঁকি নিতে চায়নি কেউ।
এর পর রঞ্জি ট্রফি ম্যাচ ২৩ জানুয়ারি থেকে। কিন্তু তার আগে দেশের মাঠে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সাদা বলের সিরিজ় শুরু হয়ে যাচ্ছে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সরাসরি না নামিয়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে শামিকে খেলিয়ে দেখে নেওয়ার ভাবনা রয়েছে। একদিনের সিরিজ়ে তো বটেই, কারও কারও মত, টি-টোয়েন্টিতেই খেলানো হোক। চোটের কারণে যশপ্রীত বুমরা এই সিরিজ়ে থাকবেন না প্রায় নিশ্চিত। তাই শামিকে আরও বেশি করে দরকার। আগামী দু’একদিনের মধ্যেই অজিত আগরকরের নেতৃত্বাধীন নির্বাচক কমিটি দল বাছতে বসবে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দল জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ১২ জানুয়ারি। তাই একই সঙ্গে ইংল্যান্ড সিরিজ় ও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দল বেছে নেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যদি শামিকে কুড়ি ওভারের দলেও রাখা হয়, তা হলে ২২ জানুয়ারি প্রিয় ইডেনেই ভারতের জার্সি গায়ে প্রত্যাবর্তন ঘটাতে পারেন শামি। দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করবেন কলকাতায়, যেখানে একদিন অজানা, অচেনা এক তরুণ হিসেবে এসে বল হাতে ঝড় তুলেছিলেন। কলকাতার ময়দান থেকে তাঁর জাতীয় দলের উড়ান ধরার কাহিনি এমনিতেই রূপকথায় স্থান করে নিয়েছে। শামি-২ যদি কলকাতা থেকে আকাশে ওড়ে, বুঝতে হবে তাঁর চিত্রনাট্য অন্যকেউ লেখেন!
গোড়ালির অস্ত্রোপচারের পরে রিহ্যাব করার জন্য বেঙ্গালুরুর জাতীয় অ্যাকাডেমিতে যেতে হয়েছিল। কে জানত, সেটাকেই ঘর-বাড়ি করে ফেলতে হবে। ভারতীয় দলে ফিরবেন বলে এতটাই মন দিয়ে রিহ্যাব করছিলেন শামি যে, বাড়িও যেতেন না। গাড়িটা আনিয়ে নিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুতে। প্রিয় বাহন চড়ে এদিক-ওদিক ঘুরতেন মন খারাপ লাগলে। না হলে জাতীয় অ্যাকাডেমির রিহ্যাব সেন্টারে পড়ে থাকা মানে হাসপাতালে ভর্তি থাকা রুগির মতো। ‘‘এক বছরে বেঙ্গালুরু থেকে আমি একবারই বাড়ি গিয়েছিলাম,’’ বৃহস্পতিবার বলছিলেন শামি। ডাক্তার, ফিজ়িয়োরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ‘‘সময় লাগবে। ধৈর্য ধরতে হবে কিন্তু।’’
ধৈর্য? মহম্মদ শামি জানেন, এই শব্দটার মানে কী। দুর্ধর্ষ সব স্পেল করে দলকে জিতিয়েছেন। তার পরেও বিনা কারণে ম্যাচের পর ম্যাচ বাইরে বসে থেকেছেন। এই তো দেশের মাঠে বিশ্বকাপেই শুরু থেকে ব্রাত্য ছিলেন। কেন, কেউ জানে না। অবশেষে যখন খেলানো হল, তিনিই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি।
এই পৃথিবীতে কেউ কেউ আসেন, যাঁদের পরীক্ষা শেষ হতে চায় না। বারবার অন্ধকার ছেঁকে ধরার চেষ্টা করে। তবু তাঁরা দমে যান না, বারবার নিজেদের প্রমাণ করে আলোয় ফিরে আসেন। মহম্মদ শামি তেমনই হার-না-মানা এক মানুষের নাম!