খাঁ-খাঁ: তখনও আসেনি ছেলের দেহ। বাড়ির দাওয়ায় বসে রয়েছেন জয়ন্ত মাহাতোর (ইনসেটে) বাবা বিবেক মাহাতো। শনিবার বাঁকুড়ার রানিবাঁধের সিন্দুরপুর গ্রামে। নিজস্ব চিত্র
গুজরাতে রাসায়নিক কীটনাশক তৈরির কারখানায় দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল বাঁকুড়ার এক পরিযায়ী শ্রমিকের। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার কোটেশ্বর রাও বলেন, ‘‘ভরুচ জেলার দাহেজ এলাকায় যে কেমিক্যাল কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছে, সেখানে বাঁকুড়ার ছ’জন ছিলেন। এক জনের মৃত্যু হয়েছে। দেহ নিয়ে আসা হচ্ছে। আমরা যা ব্যবস্থা করার, করছি।” জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বুধবার। মৃতের নাম জয়ন্ত মাহাতো (২৪)। বাড়ি রানিবাঁধ থানার সিন্দুরপুর গ্রামে। আহতদের মধ্যে চার জনের বাড়িও ওই গ্রামে। এক জন ইঁদপুরের সাতামির বাসিন্দা।
বাঁকুড়া জেলার আহত শ্রমিকদের থেকে জানা গিয়েছে, দহেজের বিশেষ আর্থিক অঞ্চলে (এসইজ়েড) রয়েছে কীটনাশক তৈরির কারখানাটি। বুধবার দুপুর ১২টা নাগাদ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সেটি কেঁপে ওঠে। তাঁদের দাবি, কারখানার বয়লার ফেটে আগুন ধরে গিয়েছিল। একের পরে এক রাসায়নিকের ট্যাঙ্কও ফেটে যায়। পুড়ে যান অনেকে। জখম হন অনেক শ্রমিক। তাঁদের মধ্যেই ছিলেন রানিবাঁধের সিন্দুরপুর গ্রামের জয়ন্ত মাহাতো, তাঁর খুড়তুতো ভাই জগন্নাথ ও সমীর মাহাতো, ওই গ্রামের সুদর্শন মাহাতো, শক্তিপদ মাহাতো এবং ইঁদপুরের সাতামির মাধব সর্দার। সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় নার্সিংহোমে। বৃহস্পতিবার দুপুরে জয়ন্তের মৃত্যু হয়।
অম্বিকানগর থেকে রাইপুর যাওয়ার পাকা রাস্তার ধারে সিন্দুরপুর গ্রাম। রাস্তার ধারেই টিনের চালের এক চিলতে বাড়ি। শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ সেখানে পৌঁছয় জয়ন্তর দেহ। তখন প্রচুর লোকের ভিড় ভেঙে পড়েছে বাড়ির সামনে। মোতায়েন ছিল রানিবাঁধ থানার পুলিশ। তারা কোনও রকমে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা করে। বাড়ির দাওয়ায় চুপ করে বসেছিলেন জয়ন্তর বাবা বিবেকবাবু। ছেলের মৃত্যুর খবর এ দিন দুপুর পর্যন্ত কেউ দেয়নি তাঁকে। পড়শিরা জানান, তাঁর মানসিক সমস্যা রয়েছে। ছোট ছেলে প্রশান্ত গ্রামেই দিনমজুরি করেন। তাঁর সঙ্গেই থাকেন বৃদ্ধ। প্রশান্ত বলেন, ‘‘বছরখানেক আগেই মা মারা গিয়েছেন। তার পরে দাদাই অভিভাবকের মতো ছিল। বাবাকে নিয়ে কী করব? কোথায় যাব?’’
জয়ন্তর খুড়তুতো দাদা মধুসূদন মাহাতো জানান, সরস্বতী পুজোর পরে, গুজরাতের কারখানায় ঠিকা শ্রমিকের কাজ নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামের পাঁচ যুবক। তিনি বলেন, ‘‘লকডাউন চললেও ওখানে কাজ জুটে গেছিল। তাই বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল না ওদের।’’ মধুসূদনবাবু জানান, মঙ্গলবার শেষ কথা হয়েছিল ফোনে। জয়ন্ত জানিয়েছিলেন, ‘লকডাউন’ উঠে সব স্বাভাবিক হলে ফিরবেন। বুধবার জগন্নাথের ফোনে দুর্ঘটনার কথা জানতে পারেন। জখমদের মধ্যে একমাত্র তিনিই মোটামুটি কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন সেই সময়ে।
নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন আহত শ্রমিক শক্তিপদ মাহাতোর স্ত্রী মমতা মাহাতো শনিবার বলেন, ‘‘বাড়ির অবস্থা খারাপ। এলাকায় কাজ নেই। তাই সরস্বতী পুজোর পরে, গুজরাতে কাজে যান আমার স্বামী।’’ সুদর্শন মাহাতোর বাবা রঞ্জিত মাহাতো, জগন্নাথ মাহাতোর বাবা দেবীপদ মাহাতো, সমীর মাহাতোর বাবা সত্যেন্দ্রনাথ মাহাতোরাও বলছেন একই কথা।
এ দিন ওই গ্রামে গিয়েছিলেন রানিবাঁধের বিধায়ক তৃণমূলের জ্যোৎস্না মান্ডি। তিনি বলেন, ‘‘মৃত ও আহতদের পরিবারগুলিকে সব রকমের সাহায্য করা হবে।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘লকডাউনের সময়েও কেন্দ্রীয় সরকার ৩০ শতাংশ কর্মী নিয়ে কাজ চালু রাখার কথা ঘোষণা করেছে। তারই জেরে অদক্ষ শ্রমিকদের দিয়ে কারখানা চালাতে গিয়ে বিস্ফোরণে হয়ে থাকতে পারে।’’ বাঁকুড়ার সাংসদ সুভাষ সরকারের কটাক্ষ, ‘‘তৃণমূলের বিধায়ক রানিবাঁধে বসেই গুজরাতের কারখানায় দুর্ঘটনার জন্য কেন্দ্রের দোষ দেখতে পাচ্ছেন। একটি দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এই রাজনীতি দুর্ভাগ্যজনক।’’