জঙ্গল কেটে রাজধানী গড়েছিলেন মল্লরাজারা। তারও কয়েকশো শতাব্দী পরে আজ থেকে ঠিক দেড়শো বছর আগে, ১৮৭৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর মল্লরাজধানীতে জন্ম হয় বিষ্ণুপুর পুরসভার। শুরু হয় আধুনিক নগরজীবনের যাত্রা।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, প্রথম পুরভবন ছিল মাটির ছিটেবেড়া ও খড়ের চালার একটি ঘর। প্রথম পুর-সভাপতি হন বিষ্ণুপুরের মহকুমাশাসক আর এম ওয়াকার। সে সময় বিষ্ণুপুর চারটি জ়োন এ, বি, সি, ডি হিসেবে ভাগ ছিল। নাগরিক পরিষেবা দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন ১২ জন কমিশনার (শহরের গণ্যমান্যদের থেকে নির্বাচিত ৮ জন ও সরকার মনোনীত ৪ জন)।
শহরের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করছেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক নীহার হাজরা। তিনি জানান, সে সময় আট বর্গ কিমি জায়গা জুড়ে ছিল বিষ্ণুপুর পুরসভা। স্বচ্ছল পাকাবাড়ির মালিকদের থেকে পুরকর নেওয়া হত। ১৯০৮ সালের ও’ম্যালির বাঁকুড়া জেলা গেজেট অনুযায়ী, ১৯০৫-’০৬ সালে করদাতা ছিলেন ২,৮০৪ জন (মোট জনসংখ্যার ১৪.৬ শতাংশ)। তখন পাঁচ বছরে পুরসভার আয় ছিল ১০ হাজার টাকা। যার ৯ হাজার টাকা খরচ হত রাস্তা পরিষ্কার, মল পরিষ্কার, ওষুধ সরবরাহ, প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনায়।
বিষ্ণুপুরের উন্নয়নে শাসক ইংরেজদের ভূমিকাও ছিল। বিষ্ণুপুরের মল্লেশ্বরের বাসিন্দা ইন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “আমার প্রপিতামহ শিবদাস ভট্টাচার্য বিষ্ণুপুর পুরসভার সহ-সভাপতি (১৯০৪) থাকাকালীন শহরের উন্নয়নের জন্য ইংরেজদের চিঠিপত্র দিয়েছিলেন। পরে সেখান থেকে আসা তহবিল থেকে ১০-১৫ টাকা খরচ করে শহরের আবর্জনা ফেলার জন্য কেনা হয়েছিল মোষে টানা গাড়ি। বর্তমান ব্লক অফিস যাওয়ার পথে পুলিশ চৌকির পাশে ১৪ বিঘা জমিতে আবর্জনা ফেলার ময়লাখানা ছিল।’’
ইতিহাস বলছে, ১৮৮১ সালে শহরে গুটিকয় বাড়িতে খাটা পায়খানা তৈরি হয়। সেই মল সংগ্রহ করার জন্য তৎকালীন পুর-সভাপতি তথা আইনজীবী ভোলানাথ ভট্টাচার্য খড়্গপুর থেকে দক্ষিণ ভারতীয় মেথরদের এনেছিলেন। সেই অমানবিক প্রথা বন্ধ হয় ১৯৮০ সালে।
শহরে পাকা রাস্তা ছিল না। তবে কেরোসিনের পথবাতি ছিল। তা অবশ্য সর্বত্র ছিল না। ১৮৮২-তে বিষ্ণুপুরে তিনটি পাকা রাস্তা তৈরি হয়। সে বছরেই বিষ্ণুপুরে তৈরি হয় দমকল কার্যালয়।
ইতিহাস জানাচ্ছে, ১৮৮৪ সালের অ্যাক্ট ৩ অনুসারে পুরসভায় প্রথম ৬টি ওয়ার্ড গঠিত হয়। সেই সময় থেকেই শুরু হল টিকাকরণ, জন্ম-মৃত্যুর তথ্য লেখার কাজ, রাস্তা মেরামত। ১৮৮৬-৮৭ সালে পুরকর নির্ধারণ কমিটি তৈরি হয়। সে সময় গরুগাড়ি থেকেও কর নেওয়া হত।
ধীরে ধীরে শহরে বসতি বাড়তে শুরু করে। পরিধিও বাড়ে শহরের। ১৯৬৪-৬৫ সালে বিষ্ণুপুর পুরসভার আয়তন ছিল ২০.৭২ বর্গ কিমি। জনসংখ্যা ৩০ হাজার ৯৫৮ (১৯৬১ সালের জনগণনা অনুযায়ী)। কমিশনার ছিলেন ১২ জন। তাঁদের মেয়াদ ছিল চার বছর। তাঁদের মধ্য থেকেই চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হত। সে সময় শহর করদাতার সংখ্যা বেড়ে হয় ৫,৮১৯ জন।
শতবর্ষের মুখ থেকে নাগরিক পরিষেবায় পুরসভার ভূমিকা বাড়তে শুরু করে।শহরবাসীর জলকষ্ট দূর করতে ১৯৬৪-৬৫ সালে বিষ্ণুপুর পুরসভা ২৯টি নলকূপ ও ৯৬টি কুয়ো তৈরি করে। তখন ২৭৯টি বৈদ্যুতিক আলো ও ১৯২টি কেরোসিনের বাতি ছিল। নিকাশি, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয় পুরসভা গুরুত্ব দিতে শুরু করে।
সে সময় শহরে মোট ৪৮.০৮ কিমি রাস্তা ছিল। শহরে ১৮টি প্রাথমিক স্কুল ও কেজি ইঞ্জিনিয়ারিং, দেবেন্দ্র স্মৃতি ব্যায়ামাগার ও শিবদাস গার্লস স্কুল ছিল। সে সবে বিষ্ণুপুর পুরসভার আর্থিক সহায়তা ছিল।
১৯৭৮ সালেই প্রথম পঞ্চায়েত ও পরে পুরসভায় রাজনৈতিক দল-ভিত্তিক নির্বাচন শুরু হয়। এ সময় পুরসভার আয়তন বাড়ে। গোপালপুর থেকে ব্লক অফিস এবং স্টেশন থেকে কৃষ্ণবাঁধ পর্যন্ত পুরসভার এলাকা চিহ্নিত হয়। প্রায় ১৯৮০ সালে নলবাহিত জল পরিষেবা চালু হয়। তারপরে ধাপে ধাপে ১৬টি থেকে ওয়ার্ড বেড়ে হয় ১৯। গবেষকদের তথ্য থেকে জানা যায়, বিষ্ণুপুর পুরসভার দক্ষিণ থেকে উত্তরে ১৬২০টি জলাশয় ছিল। পরিখা ছিল সাড়ে ১৮ কিলোমিটার।
শহরবাসীর আক্ষেপ, সাবেক মল্লরাজধানীর ইতিহাসের সাক্ষ্য এখানকার লালমাটির টিলা, পরিখা, জলাশয় অসাধু চক্রের হাতে নষ্ট হতে বসেছে। অবহেলায় নষ্ট শহরের ইতিহাসের বহু মূল্যবান নথিও। বাঙালি যে আত্মঘাতী! (চলবে)