Anubrata Mondal

Chandranath Adhikary: সাময়িক নতিস্বীকার করলেও শুধরে নিতে বলেছেন বাবা, তা-ই করেছি, বলছেন চন্দ্রনাথ

মঙ্গলবার বোলপুর মহকুমা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসক, নার্স-সহ পাঁচ জনের দল যায় অনুব্রতের বাড়িতে। নেতৃত্বে ছিলেন চিকিৎসক চন্দ্রনাথ।

Advertisement

কণাদ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০২২ ১৮:১৫
Share:

বোলপুর মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসক চন্দ্রনাথ অধিকারী। — নিজস্ব চিত্র।

গত দু’দিনে বিতর্কিত ঘটনাপ্রবাহের অন্যতম চরিত্র হয়ে উঠেছেন তিনি। খানিক দেরিতে হলেও জেগেছে চিকিৎসকের ‘বিবেক’। সেই সরকারি চিকিৎসকের নাম চন্দ্রনাথ অধিকারী। কর্মস্থল বোলপুর হাসপাতাল। তৃণমূলের ডাকসাইটে নেতার চিকিৎসার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে তাঁর নাম।

Advertisement

গত মঙ্গলবার বোলপুর মহকুমা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসক এবং পুরুষ নার্স মিলিয়ে পাঁচ জনের একটি দল গিয়েছিল তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বাড়িতে। ঘটনাচক্রে, তার পর দিন, অর্থাৎ বুধবার গরুপাচার মামলায় সিবিআইয়ের কাছে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল অনুব্রতের। যদিও শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে অনুব্রত ওই সমন শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বাড়িতে বোলপুর মহকুমা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসক দল যাওয়া নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধে। সেই দলেরই নেতৃত্বে ছিলেন চন্দ্রনাথ। যিনি দাবি করেছেন, অনুব্রতই তাঁকে ১৪ দিনের ‘বেড রেস্ট’ লিখে দিতে অনুরোধ করেন। তাৎক্ষণিক ভাবে অনুব্রতর অনুরোধ তিনি ফেলতে পারেননি বলেও জানিয়েছেন চন্দ্রনাথ।

কিন্তু খানিক পরে বিবেকের দংশনে তিনি সংবাদমাধ্যমের কাছে ‘সত্য’ বলেন। জানান, তাঁর উপর ‘চাপ’ তৈরি করা হয়েছিল। তাঁকে ‘ফাঁসানোর’-ও চেষ্টা হয়েছিল। রাজ্যের শাসকদলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার ‘অনুরোধ’, সরকারি হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘নির্দেশ’ উপেক্ষা করে সহজ সত্যি প্রকাশ্যে বলা কঠিন। অন্তত এ রাজ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তেমনই ইঙ্গিত করে। সেই নিরিখে চন্দ্রনাথের সাহস বিরল এবং ব্যতিক্রমী।

Advertisement

ইতিমধ্যেই চিকিৎসক সমাজের বড় অংশ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা চন্দ্রনাথকে কুর্নিশ জানানো শুরু করেছেন তাঁর ‘দৃষ্টান্তমূলক’ আচরণের।

গত প্রায় ছ’বছর বোলপুরের হাসপাতালে কর্মরত থাকার সময় তিনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘গোলমাল’ দেখেছেন। কিন্তু গত মঙ্গলবার ‘ছন্দপতন’ ঘটেছিল। আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন চন্দ্রনাথ। তাঁর কথায়, ‘‘সকালে হাসপাতালের সুপার বুদ্ধদেব মুর্মুর ফোন এল। উনি বললেন, ‘অনুব্রত মণ্ডল অসুস্থ। একটা মেডিক্যাল টিম তৈরি করা হয়েছে।’ আমি বললাম, ওঁকে হাসপাতালে আসতে বলুন। উনি বললেন, ‘না, এটা মেডিসিনের সমস্যা নয়। ফিস্‌চুলার সমস্যাই প্রধান। এর পরেও আমি জানতে চেয়েছিলাম, এখন তদন্ত চলছে। এখন কি যাওয়া উচিত হবে? উনি বলেন, ‘সমস্যা হবে না।’ কিন্তু আমাকে হাসপাতালের সিল বা ট্রিটমেন্ট শিট দিয়ে ওখানে পাঠানো হয়নি।’’

সুপারের নির্দেশ মতো অনুব্রতের বাড়ি গিয়ে কাজ করে ফিরে আসেন চন্দ্রনাথ। কিন্তু টের পান, পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘আমার প্রথম সন্দেহ হয়, যখন সুপার স্যর আমাকে ফোনে বলেন, ‘হাসপাতালের সিল নয়, আমার ব্যক্তিগত সিল দিতে হবে।’ তখন আমি ভাবলাম, আমাকে কি তা হলে বলির পাঁঠা করা হচ্ছে? এর পর বাড়ি ফিরে দেখলাম, ফেসবুকে এ নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে। তার পরেই মুখ খুললাম।’’

মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা ৪০ নাগাদ ফেসবুকে চন্দ্রনাথ পোস্ট করেন, ‘আই অ্যাম টায়ার্ড, নিড সায়লেন্স অ্যান্ড পিস’। অর্থাৎ, ‘আমি ক্লান্ত, নৈঃশব্দ্য এবং শান্তি চাই।’ চন্দ্রনাথের এই পোস্টে তাঁর পরিচিত বিভিন্ন জনের আবেগের বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। হাতেগোনা ব্যতিক্রমী মন্তব্য ছাড়া সকলেই দাঁড়ান চন্দ্রনাথের পক্ষে। তার বুধবারেই চন্দ্রনাথ সটান বলেন, ‘‘অনুব্রত মণ্ডলের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমি যেটা বলতে পারিনি, সেটা এখন বলছি। আমাকে ফাঁসানোর চক্রান্ত চলছে।’’

চন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, মঙ্গলবার তিনি, ইয়াকুব আলি নামে এক মেডিসিনের চিকিৎসক, এক জন পুরুষ নার্স-সহ মোট পাঁচ জন অনুব্রতের বাড়িতে গিয়েছিলেন। সরকারি ওই চিকিৎসকের বক্তব্য, ‘‘এর আগেও অনুব্রত আমাদের বাড়িতে ডেকেছিলেন। কিন্তু তখন সুপারের বিরোধিতা করে তাঁকে হাসপাতালে আনানো হয়েছিল। কোনও সমস্যা হয়নি।’’ তাঁর মতে, ‘‘এ বারেও কোনও সমস্যা হত না। যদি আমরা সংখ্যায় বেশি থাকতাম। তা হলে আমাদের মনোবল বাড়ত। কিন্তু ওই দিন আমি একা পড়ে গিয়েছিলাম।’’

তা হলে কেন ঘুরে দাঁড়ালেন?

চন্দ্রনাথের জবাব, ‘‘আমি বাবার শিক্ষা ভুলিনি। বাবা বলেছিলেন, ‘মন দিয়ে কাজ করবে। কাজে ফাঁকি দেবে না এবং মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে দেবে না। অনেক সময় চাপের মুখে তাৎক্ষণিক ভাবে নতিস্বীকার করতে হয়। পরে সেটা শুধরে নিতে বলেছিলেন বাবা। সেটাই করেছি। নিচু স্তরের কোনও কোনও রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা হচ্ছে। সেটা করছেন বিশেষ কিছু ধান্দাবাজ লোক। সে জন্য জীবন, ছন্দ, সুরক্ষা— সব কিছু ব্যাহত হচ্ছে।‌’’

আদতে বীরভূমেরই ছেলে চন্দ্রনাথ। বাবা অসীমকুমার অধিকারী ছিলেন বিশ্বভারতীর পল্লিচর্চা কেন্দ্রের বিভাগীয় প্রধান। মা রুমা অধিকারী ছিলেন পাঠভবনের বাংলার শিক্ষিকা। ১৯৯২ সালে বিশ্বভারতী বোর্ড থেকে মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষায় দ্বিতীয় হন চন্দ্রনাথ। ১৯৯৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষায় প্রথম।

১৯৯৫ সালে ডাক্তারির কাউন্সেলিংয়ে ২২তম স্থান পেয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পড়া। এর পর বিসি রায় শিশু হাসপাতাল থেকে শিশুস্বাস্থ্যে ডিপ্লোমা। পরে যোগ দেন রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরে। ২০০৮ সালে উত্তর দিনাজপুর থেকে শুরু হয় তাঁর চাকরিপর্ব। চাকরি করতে করতেই তিনি ‘মাস্টার অব সার্জারি’ হন। বদলি নিয়ে চলে যান মুর্শিদাবাদের লালবাগে। তবে মাত্র মাস তিনেকের জন্য। পরের দফার বদলিতে তিনি ফেরেন নিজের বাড়ির চৌহদ্দি সেই বীরভূমেই। ২০১৬ সালে তিনি বদলি হন বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে।

বছর ছয়েক বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে কাজ করছেন চন্দ্রনাথ। তাঁর কথায়, ‘‘এখানে সবই ঠিকঠাক চলছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আমলে রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এখন গ্রামবাংলার হাসপাতালে অনেক বড় বড় অস্ত্রোপচার হয়। তবে সব পেশাতেই কিছু না কিছু বাধা থাকে। যেমন, কিছু দিন আগে এক জন রোগী এসেছিলেন এই হাসপাতালে। তাঁর খাদ্যনালি পেঁচিয়ে সংক্রমণ হয়েছিল। তাঁর অস্ত্রোপচার করা হল এখানে। অথচ পরবর্তী পর্যায়ের অস্ত্রোপচার করতে বাধা দেওয়া হল। রোগীকে পাঠিয়ে দেওয়া হল বর্ধমানে। কিছু ধান্দাবাজ লোক এ সব করছেন। কেউ যদি ভাবেন, এগুলো নিয়ে খেলা করব তা হলে হবে না।’’

সিবিআই এবং অনুব্রত টানাপড়েন পর্বে আচমকা আলোকবৃত্তে চন্দ্রনাথ। তাঁকে ঘিরে উচ্ছ্বাসের সুর অনেকের গলায়। কিন্তু চিকিৎসকের কণ্ঠে কিছুটা আশঙ্কা, ‘‘আমার আট বছরের মেয়ে আছে। পরিবার আছে। যত ক্ষণ আমি বোলপুরে আছি, তত ক্ষণ আশঙ্কায় আছি। যতই বোলপুর আমার এলাকা হোক।’’

তার পরেই ঘুরে দাঁড়িয়ে, ‘‘আমি বদলি নিয়ে পালিয়ে যেতে চাই না। তা হলে অনেক দিন আগেই বিদেশে পালাতে পারতাম। আমি আমার জন্মভিটেতেই কাজ করব!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement