অনুব্রত মণ্ডলকে গরুপাচার মামলায় গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ডেকে পাঠাচ্ছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। তবে ১০ বার ডেকে সাড়া মিলেছে একবার।
নোটিস পাঠিয়ে, ‘আসতেই হবে’ বলে, এমনকি, অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে, এই আশ্বাস দিয়েও লাভ হয়নি। কলকাতায় সিবিআইয়ের দফতর নিজাম প্যালেসে পুলিশি প্রহরা বসানো হয়েছে। ডাকা হয়েছে চিকিৎসকদেরও কিন্তু অনুব্রত আসেননি।
অথচ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের তলব পেয়ে নির্ধারিত দিনের আগেই বোলপুর থেকে কলকাতায় এসেছে অনুব্রতের গাড়ি, বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি এসে উঠেছেন তাঁর চিনার পার্কের বাড়িতে। কিন্তু নির্ধারিত দিন সকালে যথা সময়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েও পথ বদলেছে অনুব্রতের গাড়ি।
নিজাম প্যালেসের রাস্তা ছেড়ে শেষ মুহূর্তে ঘুরে গিয়েছে এসএসকেএম হাসপাতালের দিকে।
‘ভোট পরবর্তী হিংসা’র অভিযোগে মামলাতেও অনুব্রতকে সমন পাঠিয়েছে সিবিআই। তবে গরুপাচার মামলায় প্রথম বার ‘কেষ্ট’(অনুব্রতের ডাক নাম, তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই নামেই ডাকেন)কে ডেকে পাঠানো হয় ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল। তখন পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট চলছে। ২৫ তারিখ ভোট ছিল কলকাতাতেই। ২৪ তারিখ চিঠি যায় অনুব্রতের কাছে। তবে সে ডাকের জবাব মেলেনি। অনুব্রতর আইনজীবী নির্ধারিত দিনে কলকাতায় নিজাম প্যালেসে এসে জানিয়ে যান অনুব্রত আসতে পারছেন না।
এর পর ১৪ ফেব্রুয়ারি তলব যায় কেষ্টর কাছে। তিনি অবশ্য আসেননি। কেন সিবিআইয়ের ডাকে সাড়া দিলেন না? কারণ হিসেবে তৃণমূল নেতার শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়েছিলেন আইনজীবীরা।
অনুব্রতকে তৃতীয় বার এই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সিবিআই ডেকে পাঠায় ২৫ ফেব্রুয়ারি। এ বার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তৃণমূল নেতাকে। ২৫ ফেব্রুয়ারি শ্বাসকষ্টের সমস্যায় নিয়ে বোলপুরের সিয়ান মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি হন অনুব্রত। চিকিৎসকরা অবশ্য তাঁকে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ছেড়ে দেন। কিন্তু কেষ্টর নিজাম প্যালেসে আসা হয় না আর।
এর পর ১৫ মার্চ অনুব্রতকে তলব করে সিবিআই। অনুব্রত আবার সেই তলব উপেক্ষা করেন। অবশ্য অসুস্থতার কারণ দেখাননি বীরভূমের দাপুটে নেতা। ১৪ মার্চ গরুপাচার মামলায় সিবিআইয়ের জেরা থেকে রক্ষাকবচ চেয়ে কলকাতা হাই কোর্টে আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি। তাঁর আইনজীবীরা সিবিআইকে জানিয়ে দেন, যেহেতু অনুব্রত ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করেছেন এবং মামলাটি বিচারাধীন, তাই তিনি হাজিরা দিতে পারবেন না।
৬ এপ্রিল। আবার অনুব্রতকে সিবিআই ডেকে পাঠায়। নিজাম প্যালেসে সিবিআই দফতরে যাওয়ার কথা ছিল। আগের দিনই কলকাতার চিনার পার্কের বাড়িতে পৌঁছে যান তৃণমূল নেতা। কিন্তু সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তাঁকে নিয়ে তাঁর গাড়ি সোজা পৌঁছে যায় এসএসকেএম হাসপাতালে। হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয় শ্বাসকষ্টের সমস্যা রয়েছে তৃণমূল নেতার। আছে পেটের সমস্যাও। উডবার্ন ব্লকের ২১১ নম্বর কেবিনে ভর্তি করা হয় অনুব্রতকে। তৈরি হয় আট সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডও। অপেক্ষা শেষ হয় না নিজাম প্যালেসে। অনুব্রত অবশ্য জানিয়েছিলেন, সিবিআই চাইলে তাকে হাসপাতালে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে।
২৩ এপ্রিল। আগের বারের অসুস্থতার জেরে ১৭ দিন হাসপাতালে থেকে সবে বাড়ি ফিরেছেন কেষ্ট। বাড়ি ফিরেছেন শুনে সিবিআইও সমন পাঠায়। এ বার নিশ্চয়ই তিনি জিজ্ঞাসাবাদে হাজির থাকতে পারবেন। অনুব্রত জানিয়ে দেন পারবেন না। তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও যথেষ্ট দুর্বল, হাঁটাচলা করতেও সমস্যা হচ্ছে। তাই সিবিআই সকাশে তাঁর পক্ষে আসা সম্ভব নয়। অনুব্রতর জবাব ইমেল মারফত সিবিআই দফতরে এসে পৌঁছয় তাঁর হাজিরা দেওয়ার নির্ধারিত সময়ের ঠিক চার মিনিট আগে।
১৯ মে। অবশেষে অপেক্ষার অবসান। অনুব্রত নিজেই ফোন করে সিবিআইয়ের সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ করেছেন। আইনজীবীরা জানান, অনুব্রত গরুপাচার মামলায় সহযোগিতা করতে চান। সিবিআইয়ের মুখোমুখি বসতে চান। সেই মতো সিবিআইয়ের দেওয়া সময়ের আগেই নিজাম প্যালেসে পৌঁছে যান কেষ্ট। টানা চার ঘণ্টা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে জেরা পর্ব মিটলে নিজাম প্যালেস থেকে সোজা এসএসকেএম হাসপাতালে চলে যান। হাসপাতালের তরফে জানানো হয় অনুব্রত অসুস্থ বোধ করায় তাঁকে উডবার্ন ব্লকে নিয়ে গিয়ে রুটিন চেক আপ করানো হচ্ছে।
২৭ মে আবার তলব করা হয় অনুব্রতকে। এবারও অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে হাজিরা এড়ান অনুব্রত। তবে এ বার একটু অন্যরকম ছিল অনুব্রতের প্রতিক্রিয়া। সিবিআইকে চিঠি দিয়ে তিনি লেখেন, চিকিৎসকেরা তাঁকে ১৫ দিন বিশ্রামের পরামর্শ দিয়েছেন, সিবিআই চাইলে বাড়িতে এসে কথা বলতে পারে।
৮ অগস্ট অনুব্রতকে সপ্তম বার ডেকে পাঠানো হয় গরুপাচার মামলায়। এ বারও নিজাম প্যালেসেই। কিন্তু অনুব্রত আগেই ই-মেলে জানিয়ে দেন শারীরিক কারণ তিনি সোমবার হাজিরা দাতে পারছেন না। সিবিআই যেন অন্য একটি দিনে অনুব্রতকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকে। সিবিআই অবশ্য সেই অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
আট তারিখ কলকাতায় এসে এসএসকেএমে যান অনুব্রত। অসুস্থতার পরীক্ষাও করান। হাসপাতাল থেকে অনুব্রতকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা করানোর প্রয়োজন নেই। ভাবা হয়েছিল এর পর তিনি সিবিআইয়ের তলবে সাড়া দিতে নিজাম প্যালেসে যাবেন। কিন্তু অনুব্রতর গাড়ি তাঁর বাড়ির রাস্তা ধরে। চিনার পার্ক হয়ে ওই দিনই বোলপুরে ফিরে যান।
বুধবার ১০ অগস্ট ছিল গরুপাচার মামলায় অনুব্রতকে সিবিআইয়ের অষ্টম তলব। অনুব্রত অষ্টম বারেও হাজির হননি নিজাম প্যালেসে। বুধবার তিনি নিজের বোলপুরের বাড়িতেই ছিলেন। তাঁকে ১৪ দিনের বেড রেস্ট দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।