মিজোরামে ভেঙে পড়া রেলসেতু। —পিটিআই। —ফাইল চিত্র।
মিজ়োরামের সাইরাংয়ে নির্মীয়মাণ রেলসেতু ভেঙে পড়ায় বুধবার প্রাণ গিয়েছে এ রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের। যাঁদের প্রায় সকলেই মালদহের বাসিন্দা। বৃহস্পতিবার তা নিয়ে শুরু হয়ে গেল রাজনৈতিক চাপানউতোর।
এ দিন মালদহের পুখুরিয়ার চৌদুয়ার গ্রামে গিয়ে মৃত শ্রমিকদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন সদ্য রাজ্যসভার সাংসদ সামিরুল ইসলাম। তিনি দাবি করেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশে পরিযায়ী শ্রমিক বেশি। সামিরুল রাজ্যের মাইগ্র্যান্ট লেবার ওয়েলফেয়ার বোর্ডের চেয়ারম্যানও। একই গ্রামে গিয়ে ‘রাজ্যে কোনও কাজ নেই’ বলে কটাক্ষ করেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী স্থানীয় কর্মসংস্থান তৈরিতে রাজ্য সরকারের ‘ব্যর্থতার’ দিকে আঙুল তুলেছেন। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম কাঠগড়ায় তুলেছেন রাজ্য, কেন্দ্র— দু’পক্ষকেই।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একটি অংশের মতে, এত দিন দক্ষিণ ভারত বা কাশ্মীরের মতো রাজ্যে যেতেন অধিকাংশ শ্রমিক। সেখানে জঙ্গিহানা বা দুর্ঘটনায় এ রাজ্যের পরিযায়ীদের মৃত্যুর ঘটনা বহুবার সামনে এসেছে। কিন্তু করোনার সময় থেকে দেখা যাচ্ছে, একটি দল যাচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতেও। এ বারে মিজ়োরামের সাইরাংয়ে যে দুর্ঘটনাটি ঘটল, তাতে মৃতের সংখ্যা এখন পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ২৩ জনে। যদিও একটি দেহ এখনও উদ্ধার করা যায়নি।
মিজ়োরামের প্রশাসন জানিয়েছে, উত্তর-পূর্ব রেল এবং ওই প্রকল্পের ঠিকা পাওয়া কলকাতার এবিসিআই সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, দুর্ঘটনায় সময় সেতুতে ২৬ জন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে এক ইঞ্জিনিয়ার ও দুই নির্মাণ কর্মীকে জখম অবস্থায় উদ্ধার করা গিয়েছে। আহত ‘সাইট ইঞ্জিনিয়ার’ হুগলির ব্যান্ডেলের দক্ষিণ নলডাঙার শুভ সর্দারকে খাদ থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঘটনার তদন্তে রেল মন্ত্রক উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গড়েছে। পূর্ব রেলের মালদহের ডিআরএম বিকাশ চৌবে জানান, মৃতদের পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে।
পুখুরিয়ার চৌদুয়ার, ইংরেজবাজারের সাট্টারি, কালিয়াচক, গাজলে গিয়ে সামিরুল এ দিন রাজ্য সরকারের তরফে মৃতদের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা আর্থিক সাহায্য দেন। সরকারি নানা সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দেন। পরে তিনি বলেন, “পরিযায়ী শ্রমিকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের পরিকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। সরকারি প্রকল্পে পাঁচ লক্ষ টাকা করে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঋণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ‘দুয়ারে সরকার’-এর শিবিরে আবেদনের মাধ্যমে পরিযায়ী শ্রমিকেরা সে সুযোগ পাবেন।” সামিরুলের দাবি, রাজ্যে এক লক্ষ নির্মাণ শ্রমিক এবং চটকলে ৫০ হাজার শ্রমিক প্রয়োজন। রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের সে কাজে লাগানো হচ্ছে।
কিছু পরেই গ্রামগুলিতে যান অধীররঞ্জন চৌধুরী। তিনি বলেন, “শুধু ১০০ দিনের প্রকল্পে নয়, রাজ্যের কোথাও কোনও কাজ নেই। রাজ্যের উচিত, দুর্ঘটনায় মৃতদের জন্য অনুদান বাড়ানো।” রাজ্যের সমালোচনায় মুখর শুভেন্দুও। রাজ্যে বড় শিল্প তো দূর, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পেও এখন কর্মসংস্থানের সুযোগ সঙ্কুচিত বলে দাবি করে শুভেন্দুর মন্তব্য, ‘‘পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যাপারটাও জ্বলন্ত সমস্যার চেহারা নিয়েছে।’’ সিপিএম নেতা সেলিম বলেন, ‘‘সংবিধান অনুযায়ী, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আর রাজ্য সরকারের আইন আছে, কে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে, তাঁদের নথিভুক্ত করা দরকার।’’
তবে কোনও বার্তাতেই শোক বাধা মানছে না ইংরেজবাজার ব্লকের সাট্টারি গ্রামের চল্লিশোর্ধ্ব মহিলা সারথি সরকারের। দুর্ঘটনায় স্বামী, ছেলে, জামাই, নাতিকে হারিয়ে দিশাহারা তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, “বাড়ি যে একেবারে পুরুষশূন্য হয়ে গেল।” কান্নার ছবি চৌদুয়ার গ্রামেও। স্থানীয় বাসিন্দা সেনাউল হকের স্ত্রী মিলি বিবি বলেন, “কালকে শুনলাম, স্বামী মারা গিয়েছেন। এ দিন বলা হচ্ছে, আমার স্বামী নিখোঁজ। কী হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছি না!”
রাজভবন সূত্রে খবর, আজ, শুক্রবার সকালে মালদা রওনা হওয়ার কথা রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের।