গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
নামী সংস্থার একই স্বর্ণবিপণিতে ক্রেতা সেজে ঢুকে কয়েক কোটি টাকার অলঙ্কার লুটের ছক কষা হয়েছিল জেলের ভিতরে বসে। পুরুলিয়া শহরের নামোপাড়ার ডাকাতিকাণ্ডের তদন্তে নেমে এমনটাই জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। ওই ঘটনায় ইতিমধ্যেই দু’জনকে গ্রেফতার করেছে জেলা পুলিশ। ধৃতেরা হলেন করণজিৎ সিংহ সিধু এবং বিকাশ কুমার। পুলিশ সূত্রে খবর, প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসা তথ্য এবং ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মূল অভিযুক্তেরও খোঁজ মিলেছে। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, তিনি বর্তমানে ভিন্রাজ্যের একটি জেলে রয়েছেন। সেখানে বসেই ডাকাতির গোটা পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
গত ২৯ অগস্ট, মঙ্গলবার পুরুলিয়ায় যখন ডাকাতির ঘটনাটি ঘটে, ওই সময় নদিয়ার রানাঘাটে ওই একই সংস্থার স্বর্ণবিপণিতেও ডাকাতি হয়েছে। দুই ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করেছিলেন তদন্তকারীদের একাংশ। পরে তদন্ত যত এগোয়, পুরুলিয়ার ঘটনায় ঝাড়খণ্ড-যোগ প্রকট হতে থাকে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, নামোপাড়া সংলগ্ন বিভিন্ন রাস্তার সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখে তদন্তকারীরা নিশ্চিত হয়েছিলেন, দুষ্কৃতীরা ঝাড়খণ্ডের দিকেই গিয়েছে। জেলা পুলিশের একটি দল গিয়েওছিল পড়শি রাজ্যে। সেই ঝাড়খণ্ড থেকেই গ্রেফতার হয়েছেন করণজিৎ। তাঁর বাড়ি ওই রাজ্যের পাথরডি থানার চাসনালায়। আর বিকাশ গ্রেফতার করা হন নয়ডা থেকে। শনিবার ধৃতদের পুরুলিয়া আদালতে হাজির করানো হয়। তাঁদের ১৪ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
সাংবাদিক বৈঠকে পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, দিন দুয়েক আগে নামোপাড়ার স্বর্ণবিপণিতে এসে গয়না বেছে অগ্রিম দিয়ে গিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। তাই, ‘অপারেশন’ সারতে তারা যখন দোকানে ঢোকে, প্রথম দুই দুষ্কৃতীকে দোকানের কর্মীরা সন্দেহের চোখেই দেখেননি। আর সেই সুযোগেই মিনিট কুড়ি-বাইশের মধ্যে লুটপাট সেরে কার্যত বিনা বাধায় চম্পট দেয় অপরাধীরা। শহরের বিভিন্ন রাস্তার সিসিটিভি ফুটেজ থেকে দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। ফুটেজে দেখা গিয়েছে, পালানোর সময় একটি বাইকে তিন জন যাচ্ছিলেন। তাদের সঙ্গে বড় ব্যাগ ছিল। শনিবার সাংবাদিক বৈঠকে জেলা পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সাত জন যুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যেই দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরও পাঁচ জনের খোঁজ চলছে। অভিজিৎ বলেন, ‘‘ডাকাতির ঘটনায় মূল অভিযুক্তের খোঁজ মিলেছে। সে বর্তমানে ভিন্রাজ্যের জেলে রয়েছে। সেখানে বসেই ডাকাতির ছক কষেছে সে।’’
তদন্তকারীদের একটি সূত্র জানিয়েছে, ডাকাতির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে যে সাত জনের হদিস মিলেছে, তাঁরা ছাড়াও আরও অনেকেই এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। এই চক্রের ‘নেটওয়ার্ক’ গোটা দেশেই ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন প্রান্তে ডাকাতিও করেছে তারা। এ রাজ্যের হুগলির চন্দননগর এবং উত্তর ২৪ পরগনার দমদমেও অতীতে তারা ডাকাতি করেছে বলে খবর পুলিশ সূত্রে। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, এই চক্রে তিনটি দল রয়েছে। একটি দল দেখে, কোথায় ডাকাতি করা হবে। অর্থাৎ, দোকানের খোঁজ দেওয়া। তারাই রেইকি করে। দ্বিতীয় দলের কাজ মোবাইল-সহ অন্যান্য প্রযুক্তি সাহায্য প্রদান করা। আর তৃতীয় দল সরাসরি দোকান লুটের সঙ্গে জড়িত থাকে।
পুরুলিয়ার সঙ্গে রানাঘাটের ডাকাতির ঘটনার যোগসূত্রেরও হদিস মিলেছে বলে খবর পুলিশ সূত্রে। তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, রানাঘাট শহরের মিশন রোডের পাশে থাকা গয়নার দোকানে ডাকাতির ঘটনায় ওই দিনই পাঁচ দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে এক জন হলেন কুন্দন সিংহ ওরফে ‘ফাইটার’। গ্রেফতারির পর তাঁকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, এ রাজ্যে একাধিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। অভিযোগ, কুন্দনই দুর্গাপুরের কয়লা কারবারি রাজু ঝা খুনের মূল চক্রী। পুলিশ সূত্রে খবর, গাঁজা এবং হেরোইনে আসক্ত কুন্দন মূলত নেশার টাকা জোগাড় করতেই ‘শুটার’ হন। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশের একটি খুনের ঘটনাতেও তাঁর নাম উঠে এসেছিল। রানাঘাট পুলিশ সূত্রে খবর মিলেছে, পুরুলিয়াকাণ্ডে জেলবন্দি মূল অভিযুক্তের সঙ্গে এই কুন্দনের যোগাযোগ ছিল। শুধু তা-ই নয়, ওই ‘অপরাধী’র হাত ধরেই অপরাধ জগতে প্রবেশ ফাইটারের।