Partha Chatterjee

‘মরে গেলে আর আমার বিচার করবেন কী করে?’ এজলাসে উঠে দাঁড়িয়ে বিচারককে প্রশ্ন পার্থের

মঙ্গলবার আলিপুরের বিশেষ সিবিআই আদালতে নিয়োগ দুর্নীতি মামলার শুনানি চলছিল। সেখানে সশরীরে হাজির করানো হয় পার্থকে। এজলাসে তাঁর আইনজীবী নিজের মক্কেলের অসুস্থতার কথা জানান বিচারককে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২৩ ১৫:১০
Share:

আদালতে পার্থ উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে জানান নিজের অসুস্থতার কথা। — ফাইল চিত্র।

তিনি অসুস্থ। জেলে সঠিক সময়ে চিকিৎসা হচ্ছে না। মঙ্গলবার আলিপুরের বিশেষ সিবিআই আদালতের এজলাসে দাঁড়িয়ে এমন অভিযোগই করলেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসা না হওয়ার কারণে যদি তাঁর মৃত্যু হয়, তবে বিচার কী ভাবে হবে, বিচারকের উদ্দেশে এ প্রশ্নও করেন তিনি। অভিযোগ পেয়ে বিষয়টি দেখার আশ্বাস দেন বিচারক। ১৩ জুন পর্যন্ত পার্থকে বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পাঠানো হয়েছে।

Advertisement

মঙ্গলবার আলিপুরের বিশেষ সিবিআই আদালতে নিয়োগ দুর্নীতি মামলার শুনানি চলছিল। সেখানেই সশরীরে হাজির করানো হয় পার্থকে। এজলাসে তাঁর আইনজীবী বিচারককে নিজের মক্কেলের অসুস্থতার কথা যখন বলছিলেন, তখনই নিজের জায়গায় উঠে দাঁড়ান পার্থ। হাত জোড় করে বিচারককে জানান নিজের শরীর খারাপের কথা। বিচারকের উদ্দেশে পার্থ বলেন, ‘‘স্যর একটা কথা বলতে চাই। আমার অসুস্থতার কথা জেল সুপার লিখে দিচ্ছেন হাসপাতালক কর্তৃপক্ষকে। হাসপাতাল ১০ দিন পর রিপোর্ট ব্যাক করছে (ফেরত পাঠাচ্ছে)। এক জন আক্রান্ত হবেন, তার ১০ দিন পর এসে চিকিৎসক দেখবেন! দেখুন একটু।’’

জবাবে বিচারক জানান, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না। তাঁর কথায়, ‘‘আপনি প্রথম জানালেন। দেখছি ব্যাপারটা।’’ পার্থ এর পরে আরও জোরালো ভাবে আর্জি জানান। তিনি বিচারকের সামনে হাত জোড় করে বলেন, ‘‘দেখুন স্যর! মরে গেলে আর বিচার করবেন কী করে? স্যর, ৩০০ দিনের উপর হয়ে গিয়েছে।’’ এর পরে বিচারক বলেন, ‘‘ঠিক আছে।’’

Advertisement

সোমবার পার্থ-‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের আইনজীবী আদালতে দাবি করেছিলেন, নিয়োগ দুর্নীতিতে তাঁর মক্কেলের কোনও ভূমিকা নেই। মূলচক্রী (মাস্টারমাইন্ড) পার্থ। নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে গ্রেফতারও হয়েছেন অর্পিতা। এ নিয়ে মঙ্গলবার পার্থকে আদালতে ঢোকার সময় প্রশ্ন করেন সাংবাদিকেরা। রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী যদিও এ নিয়ে মুখ খোলেননি। সাংবাদিকদের দিকে না তাকিয়ে পুলিশি ঘেরাটোপের মধ্যে আদালত চত্বরের দিকে হাঁটতে শুরু করেন। তবে আদালত চত্বরে অন্য একটি প্রশ্নের জবাব তিনি দিয়েছেন। সোমবার কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন সাগরদিঘির বিধায়ক বাইরন বিশ্বাস। এ নিয়ে পার্থ বলেন, ‘‘সবাই আসবে’’।

আগে যা ঘটেছে

২০২২ সালের ২৩ জুলাই রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করা হয় তাঁর নাকতলার বাড়ি থেকে। তার আগে প্রায় ২৭ ঘণ্টা ধরে তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। রাজ্যের স্কুলগুলিতে শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মী নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে তখন উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ। সেই মামলায় আর্থিক দুর্নীতির তদন্তে নেমেছিল ইডি। তল্লাশিতে পার্থের বাড়ি থেকে পাওয়া যায় কিছু দলিল। সেই সব দলিলে নাম ছিল অর্পিতা মুখোপাধ্যায় নামে এক মডেল অভিনেত্রীর। যিনি আবার ‘পার্থের পুজো’ বলে পরিচিত নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের দুর্গা পুজোর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরও ছিলেন। সূত্র খুঁজে ইডি অর্পিতার বাড়িতেও তল্লাশি চালায়। সেখান থেকে নোটের পাহাড় উদ্ধার করেন ইডির গোয়েন্দারা। প্রায় ২১ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয় অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে। সেই টাকার পাহাড়ে পাওয়া যায় রাজ্যের শিক্ষা দফতরের স্ট্যাম্প দেওয়া বেশ কিছু খামও। এর পরই রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী তথা তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী পার্থকে গ্রেফতার করে ইডি। গ্রেফতার করা হয়, তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতাকেও।

পার্থ সেই সময় শুধু রাজ্যের মন্ত্রীই নন, শাসকদল তৃণমূলের দ্বিতীয় শীর্ষপদে রয়েছেন। তৃণমূলের ‘পুরনো সৈনিক’ তখন দলের মহাসচিব। পদ মর্যাদায় দলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরেই তাঁর স্থান। যুক্ত রয়েছেন দলের একাধিক প্রশাসনিক পদেও। তাঁর গ্রেফতারির পর পার্থ জানিয়েছিলেন, ইডি তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালানোর সময় তিনি দলনেত্রীকে ফোন করার চেষ্টা করলেও যোগাযোগ করতে পারেননি। এর পর একে একে অর্পিতার বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়ে আরও ২৮ কোটি টাকা উদ্ধার করে ইডি। উদ্ধার হয় কোটি কোটি টাকার সোনার অলঙ্কার। পার্থ এবং অর্পিতার নামে কিছু জমি এবং বাড়ির দলিলেরও হদিস পাওয়া যায়। একের পর এক বেআইনি অর্থ উদ্ধারের ঘটনায় এর পর দল এবং তৃণমূল সরকারের তরফেও পার্থের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হয়।

পার্থের হাতে ছিল তিনটি দফতর— শিল্প-বাণিজ্য, তথ্য-প্রযুক্তি এবং পরিষদীয় দফতরের দায়িত্ব। এই তিন দফতরের দায়িত্বই পার্থের হাত থেকে নিয়ে নেন মুখ্যমন্ত্রী। পরে দলের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির তরফেও পার্থকে তাঁর দলীয় সমস্ত দায়িত্ব থেকে সাসপেন্ড করা হয়। তৃণমূলের তরফে একটি সাংবাদিক বৈঠকে সেই ঘোষণা করেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেক জানান, যত দিন না পার্থ নির্দোষ প্রমাণিত হচ্ছেন, তত দিন দলের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে।

নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে এর পর পার্থকে আলাদা আলাদা ভাবে হেফাজতে নিয়ে জেরা করেছে তদন্তকারী দুই কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি এবং সিবিআই। হেফাজতে থাকাকালীন বার বার পার্থ তাঁর অসুস্থতার কথা জানিয়ে জামিন চেয়েছেন। শেষে তাঁকে ভুবনেশ্বরের এমসে পরীক্ষা করাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এমস জানিয়ে দিয়েছে, পার্থের যা শারীরিক অবস্থা, তাতে তাঁর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই। এর পরে দীর্ঘ হেফাজত শেষে পার্থকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে প্রেসিডেন্সি জেলে। তার পর থেকে সেখানেই রয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী।

নিয়োগ দুর্নীতিতে পার্থের বিরুদ্ধে ইডি এবং সিবিআইয়ের আলাদা আলাদা মামলা রয়েছে। চার্জশিটে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, রাজ্যে যে সময় এসএসসি-র নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে, সেই সময় শিক্ষা দফতরের দায়িত্বে ছিলেন পার্থই। এসএসসিতে নিয়োগে অনিয়মের সঙ্গে স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির যোগ রয়েছে বলে অভিযোগ, সেই কমিটি পার্থেরই হাতে গড়া। কমিটির প্রধান উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিন্‌হার কাছ থেকে বহু পরীক্ষার্থীর নামের তালিকা এবং দুই এজেন্টের যোগের প্রমাণ পেয়েছে তদন্তকারীরা। তদন্তে নেমে তারা জানতে পেরেছে, এই শান্তিপ্রসাদকে ওই পদে বহাল রাখার জন্য তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও শিক্ষা দফতরের নিয়ম বদলানো হয়েছিল। তদন্তকারীদের কথায়, যা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া সম্ভবই নয়।

এর পরেও নিয়োগ দুর্নীতিতে যত বার কুন্তল ঘোষ, অয়ন শীল, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ‘এজেন্ট’দের গ্রেফতার করা হয়েছে, তত বারই প্রকাশ্যে এসেছে পার্থের নাম। কখনও কুন্তল জেরায় জানিয়েছেন, পার্থের দফতরের আপ্ত সহায়ক সুকান্ত আচার্যকে টাকা পৌঁছে দেওয়া কথা। কখনও অয়ন জানিয়েছেন, পার্থের ‘লোক’ বলে কুন্তল দু’একজনের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। তাঁদের হাতে বিভিন্ন সময়ে ঘুরপথে নিয়োগের টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে সুকান্তকে ডেকে পাঠানো হয়েছে ইডির দফতরে। পার্থের ঘনিষ্ঠ এই আমলার বাড়িতেও তল্লাশি চালায় কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা।

তবে বন্দিদশায় গত দশ মাসে আরও অনেক কিছুই হয়েছে পার্থের সঙ্গে। কখনও হাসপাতালে যাওয়ার পথে জুতো ছুড়ে মারা হয়েছে প্রাক্তনমন্ত্রীকে। কখনও আদালত চত্বরে তাঁকে দেখে উঠেছে ‘চোর চোর’ স্লোগান। পার্থও বিভিন্ন সময়ে সংবাদ মাধ্যমের নানা প্রশ্নের জবাবে নিজেদের বক্তব্য জানিয়েছেন। কখনও দলের পক্ষে দলনেত্রীর সমর্থনে কথা বলেছেন। কখনও বা অভিষেককে তাঁর ‘নবজোয়ার যাত্রা’র জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন।

এক সময়ে নিয়মিত জেলে তাঁর সমস্যার কথা জানাতেন পার্থ। অসুবিধার কথা বলতেন। ইদানীং সব সময় আদালতে জামিনের আবেদনও করেন না। প্রেসিডেন্সির পয়লা বাইশ ব্লকের দু’নম্বর সেলের বাসিন্দা এখন পার্থ। তাঁকে জেলে দেওয়া বিশেষ সুবিধা নিয়ে সম্প্রতি প্রশ্ন তুলেছিল আদালত। জেলের নিয়ম ভেঙে পার্থের হাতে আংটি পরতে দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন বিচারক। তার পরেই পার্থের হাত থেকে আংটি, ঘড়ি এমনকি, লাল-হলুদ সুতোর তাগা খুলে ফেলা হয়।

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তন ছাত্র। কলেজজীবন থেকেই রাজনীতি করেছেন পার্থ। আশুতোষ কলেজে পড়ার সময়ে ছাত্র পরিষদ এবং পরে কংগ্রেসে যোগ দেন। বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থায় মানবসম্পদ আধিকারিক পদে চাকরিও করছিলেন সমান্তরাল ভাবে। কিন্তু তৃণমূল গঠনের পরে চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি রাজনীতিতে মন দেন। প্রথম বার বিধানসভা নির্বাচনে জেতেন ২০০১ সালে। বেহালা পশ্চিম আসনে তার পর থেকে টানা ২০১৬ পর্যন্ত জিতেছেন তিনি। শুধু তাঁর জন্যই তৃণমূলে তৈরি করা হয়েছিল ‘মহাসচিব’ পদ। বাম জমানায় বিরোধী দলনেতার ভূমিকা পালনের পরে তৃণমূল জমানায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রিত্ব সামলেছেন পার্থ। আপাতত তাঁর বিরুদ্ধে চলছে বহু মামলা। মুক্তি পাবেন না শাস্তি, উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement