প্রতীকী ছবি।
জাতপাত, ধর্মীয় ভেদাভেদে ক্ষতবিক্ষত একটা দেশকে সম্প্রীতির মন্ত্রে দীক্ষিত করতে সবার আগে এগিয়ে আসতেই হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। ছাত্রছাত্রী এবং যুবসমাজের মধ্যে সমাজ বদলের যে অযুত সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে, দেশ ও দশের কল্যাণে তাকে বারবার জাগিয়ে তুলতে হয়। ধর্মের জিগির তোলা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই হোক অথবা সমাজের হাজার বৈষম্যকে আগলে রাখা শেওলা-ধরা কারাগার— সকলেরই রুদ্ধ প্রাচীরগুলি ভেঙে ফেলার ক্ষমতা রাখে এই ছাত্রসমাজ। ‘আমরা শক্তি, আমরা বল, আমরা ছাত্রদল’— যুগে যুগে বারবার এ কথা প্রমাণিত হয়েছে। আর, তা হবেও!
এ বার সরস্বতী পুজোকে কেন্দ্র করে এমনই সম্প্রীতির খোলা হাওয়ায় মেতে উঠেছে হিঙ্গলগঞ্জে আমাদের প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কনকনগর এস ডি ইনস্টিটিউশন। এ বছর স্কুলের পড়ুয়ারাই স্থির করেছিল— ‘‘ঠাকুরমশাইয়ের দরকার নেই।’’ তাই ভোটাভুটির মাধ্যমে মূল পুরোহিতের দায়িত্ব বর্তেছে প্রধান শিক্ষকের উপরে! আর তাঁকে
পৌরোহিত্যে সাহায্য করবে সপ্তম শ্রেণির লিপিকা পরভিন, দশম শ্রেণির মালিহা মুমতাজ এবং নবম শ্রেণির জিন্নাতুল ফিরদৌস জলি। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, স্কুলে সব পড়ুয়াদের উপস্থিতিতেই তা স্থির হয়েছে। আবৃত্তি, সঙ্গীত, আলপনায় বাকিদের সঙ্গেই এই প্রাক্-বসন্ত উৎসবে মেতে উঠবে মালিহা-লিপিকা-জিন্নাতুলরা।
সেই পুজোর আগে প্রস্তুতির দিনগুলিতে যেন উদ্দীপনায় টগবগ করে ফুটেছে গোটা স্কুল। ফল-ফুলের বাজার করতে কিছু ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে বাজারে ছুটেছেন শিক্ষক নৌশাদ হোসেন। প্রস্তুতির তদারকি করতে সারা স্কুলে চরকি পাক দিয়েছেন ক্রীড়া শিক্ষক ইউনুস আলি। তাঁর চিন্তা— ‘সম্প্রীতির উৎসবে কেউ যেন বাদ না পড়ে’। মিড-ডে মিলে ছাত্রছাত্রীদের জন্য লুচি-আলুরদম আর মিষ্টির ব্যবস্থা করতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষক সুকান্তকুমার দাস। ‘‘তবে ক্লান্ত হয়ে গেলে যে সম্প্রীতির উৎসবে ঘাটতি পড়বে আমাদের’’— অকপটে জানাচ্ছেন তিনি। কিছু পড়ুয়া জড়ো করে তাদের গলায় সম্প্রীতির গান তোলাতে ব্যস্ত বিজ্ঞানের শিক্ষক শ্যামল ঘোষ। সরস্বতী পুজোর সময়ে মন্ত্রের বদলে সেই গানই যে গাওয়া হবে ধুমধাম করে! দেবী-বন্দনায় ‘পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র’টিও তাই লেখা হয়েছে অন্য ভাবে।
বিপন্ন পরিবেশ, জাতপাতের লড়াইয়ে দীর্ণ, নারীকে অসম্মানের দীনতায় বারবার ভুগতে থাকা এই দেশ, এই সমাজের জন্য সরস্বতী পুজোর পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্রকে তো খানিকটা আধুনিক হতেই হবে। তাই এ বার হাতে ফুল নিয়ে আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে উচ্চারণ করবে নতুন মন্ত্র—
‘জয় জয় দেবী চরাচর সারে
পৃথিবী হোক শোভিত বৃক্ষ-পুষ্প হারে
বীণা পুস্তক রঞ্জিত হস্তে
স্কুলে থাক সব শিশু, নির্ভীক চিত্তে
চিন্তারা প্রসারিত, সঙ্কীর্ণতা উহ্য
জাতপাত মুছে গেলে, মনুষ্যত্বই মুখ্য
ভগবতী ভারতী সব নারী এই দেশে
সম্মানে শ্রদ্ধায় তাঁরাই নমস্তুতে’।
সিস্টেমের সাথে লড়তে গেলে তো সিস্টেমের ভিতর দিয়েই যেতে হয়। গোঁড়ামি ও কুসংস্কারকে সেই সিস্টেমের ভিতরে থেকেই নির্মূল করতে হয় একে একে। না হলে নতুন পৃথিবী তৈরি হবে কী ভাবে?
আমাদের প্রিয় পড়ুয়াদের তাই শেখাতে হবে নতুন কিছু শপথের ভাষা। আর সেই ভাষা তাদের রপ্ত করতে হবে শৈশব থেকেই। আসলে পুজোর অঞ্জলি আর শপথে আমরা তো কিছু পার্থক্য দেখি না। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নতুন
পৃথিবীর জন্য সব ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের জয়গানের মন্ত্র শেখাতে হবে সমাজকে।
(লেখক কনকনগর এস ডি ইনস্টিটিউশন, হিঙ্গলগঞ্জের প্রধান শিক্ষক)