প্রতীকী ছবি।
চাঁদনি চকে ছোট্ট চা-তেলেভাজার দোকান বিনোদ সাউয়ের। খদ্দেরপিছু কমবেশি ২০ টাকা আয়। ২০১৬ সালের নভেম্বরে নোটবন্দির সেই দোকানেও অনলাইন লেনদেনের নোটিস পড়েছিল। নেটের ‘ন’ না-বুঝলেও ওই স্টিকার সাঁটাতে কার্যত বাধ্য হয়েছিলেন বিনোদ।
একাধিক সমীক্ষা বলছে, নোটবন্দির পরে ইচ্ছে না-থাকলেও নেট-লেনদেনের প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকতে বাধ্য হয়েছিলেন বিনোদের মতো বহু মানুষ। ইন্টারনেট ব্যবহারের সুরক্ষা কবচ সংক্রান্ত ধারণা ছাড়াই পড়ি-কী-মরি করে এত ঝক্কি সামলাতে গিয়ে বিপদেও পড়েছেন অনেকে। বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে এসেছে, নোটবন্দির পরে এক-একটি অনলাইট ওয়ালেট সংস্থার লেনদেন প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেড়ে যায়। এবং বাজারে নতুন নোট চালু হলেও অনলাইন লেনদেনে ভাটা পড়েনি।
কোভিড-লকডাউন পর্বেও ফের সেই একই চিত্র। এ বারে বিপন্নতার মাত্রা আরও তীব্র। দেখা গিয়েছে, অনলাইন খাবার ডেলিভারি বা অনলাইন মুদির দোকানে ক্রেতা বেড়েছে এবং এই সংস্থাগুলি বহু ক্ষেত্রেই ক্রেতার সঙ্গে শারীরিক দূরত্ববিধি বজায় রাখার জন্য নেট লেনদেনে উৎসাহ দিচ্ছে। বাইরে বেরনো বন্ধ হওয়ায় এবং এটিএম এড়িয়ে চলতে নেট-আনাড়ি প্রবীণরা পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে অনলাইন টাকা লেনদেনে উৎসাহিত হয়েছেন। অনলাইন সংস্থাগুলিও এমন লোভনীয় অফার দিচ্ছে যে, সেই আশায় বহু মানুষ নগদ টাকার বদলে এই ধরনের লেনদেনে মজে থাকছেন।
প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার্স সংস্থার একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, লকডাউন পর্বে সব থেকে বেশি অনলাইন ওয়ালেট এবং বিভিন্ন পেমেন্ট গেটওয়ের ব্যবহার হয়েছে। ন্যাশনাল পেমেন্ট কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ক্রমাগত ইউপিআই মাধ্যমে লেনদেন বেড়েছিল। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে শুধু ইউপিআই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ৩ লক্ষ ২৯ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল। এই পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়েই বেড়ে চলেছে নেটমুলুকে ওত পাতা শিকারীর ফাঁদে পড়ার ভয়। ঠোক্কর খেতে খেতে যাঁরা নেট-কসরত রপ্ত করেছেন, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের গ্রাস করেছে নেটপরিসরে গুপ্তচরের খপ্পরে বিপদে পড়ার আশঙ্কা।
এই আশঙ্কার নানা রকমফের, তা নজরে এসেছে মনোবিদদেরও। মনোবিদ শিনা মিশ্র ঘোষ বলছিলেন, “ইদানীং বাস্তব জীবনের নানা সমস্যায় লোকে যতটা বিচলিত হয়,ভার্চুয়াল জগতের সমস্যাও তাঁদের ঠিক ততটাই মুশকিলে ফেলে। পেগাসাসের ফাঁদের কথা তো আমরা সবে শুনছি। কিন্তু তার ঢের আগেই বয়স্ক থেকে তরুণতরুণী অনেককেই তাঁদের স্মার্টফোন হ্যাক হওয়া নিয়ে আতঙ্কে ছটফট করতে দেখেছি।” বাস্তবিক অনেকের কাছেই এ যেন উভয়সঙ্কট।
করোনায় স্ত্রী গত হওয়ার পরে গড়িয়ার বাসিন্দা অশীতিপর বৃদ্ধ আমেরিকায় নাতিনাতনিদের দেখতেও নেটমাধ্যমেই চরম নির্ভরশীল। কিন্তু তাঁর মনেও ভয় ঢুকেছে, কারা যেন তাঁর অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে আর্থিক সঞ্চয় হস্তগত করার চেষ্টা করছে। ত্রিশোর্ধ্ব তরুণীর ভয়, সাইবার দুশমনরা চক্রান্ত করে তাঁর প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার চেষ্টায় শামিল। পেগাসাস-কাণ্ড খোলসা করেছে, নেটমাধ্যম কাজে লাগিয়ে ব্যক্তির গোপনীয়তার দফা রফা করা সম্ভব। কিন্তু নেটবিহীন জীবনযাপনও এখন অসম্ভব। এই টানাপড়েনে অনেকেই শারীরিক ভাবেও বিপর্যস্ত বলে চিন্তিত মনোবিদেরা।