রাজ্য সভাপতি কে হবেন তা নিয়ে জল্পনার অবসান বনশলের মন্তব্যে। — ফাইল ছবি।
সুকান্ত মজুমদারের পর আগামী ডিসেম্বরে পরিষদীয় দলের পাশাপাশি রাজ্য বিজেপির দায়িত্বও কি পেতে চলেছেন শুভেন্দু অধিকারী! এ নিয়ে জল্পনার পারদ চড়ছিল সর্ব স্তরে। বিজেপির দিল্লির কোনও নেতা বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এর সারবত্তা নিয়ে কোনও দিন মুখ না খুললেও দলের অন্দরে এই কানাঘুষো গতি পেয়েছিল যথেষ্টই। কিন্তু বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সুনীল বনশল সেই জল্পনায় জল ঢাললেন। রাজ্য সফরের তৃতীয় তথা শেষ দিনে সুকান্তকে পাশে বসিয়ে বনশল জানিয়ে দিলেন, নেতা থাকছেন সুকান্তই।
বাংলায় দলের হালহকিকত সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে রাজ্য সফরে বেরিয়েছেন বনশল। এ বারের কর্মসূচি মূলত উত্তরবঙ্গে। রবিবার শিলিগুড়ি, সোমবার মালদহের পর মঙ্গলবার এই দফায় সুনীলের তৃতীয় তথা শেষ ‘বিশেষ সাংগঠনিক বৈঠক’ ছিল উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের ইনস্টিটিউট হলে। হাজির ছিলেন বালুরঘাটের বিজেপি বিধায়ক অশোক লাহিড়ী, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা রায়গঞ্জের বিজেপি সাংসদ দেবশ্রী চৌধুরী-সহ বিজেপির দুই সাংগঠনিক জেলা বালুরঘাট ও রায়গঞ্জের সব মণ্ডল সভাপতি এবং সেই পর্যায়ের উপরের নেতারা। ইনস্টিটিউট হলে উপস্থিত এক নেতা জানিয়েছেন, বৈঠকে স্পষ্ট ভাষায় বনশল বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচন সুকান্ত মজুমদারের নেতৃত্বেই আমরা লড়ব।’’ শুভেন্দুর নাম না নিয়েও তিনি বলেন, ‘‘কোনও এক জনের উপরে নির্ভর করে ভোটের লড়াই হবে না। দলবদ্ধ ভাবে বিজেপি লড়াই করবে। একটা টিম হিসেবে লোকসভা ভোট পর্যন্ত লড়াই চলবে এবং ভাল ফল হবে বর্তমান নেতৃত্বের মাধ্যমেই।’’ ওই নেতা আরও জানিয়েছেন, কী ভাবে পঞ্চায়েত ভোটে লড়াই করতে হবে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাও দিয়েছেন বনশল। সেই সময়ই তিনি এ কথা বলেন। বনশল বার বার একটি ‘টিম’ হয়ে লড়াই করার বার্তা দিয়েছেন। বৈঠকে হাজির বিজেপি নেতৃত্বের মতে, বনশল স্পষ্ট ভাষাতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন রাজ্যে নেতৃত্বে রদবদলের কোনও সম্ভাবনা নেই। একই সঙ্গে রাজ্য কমিটিও যে একই থাকছে তা-ও বনশলের কথায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
বিজেপির অভ্যন্তরীণ কাঠামোয় দলের পরিষদীয় নেতা এবং সভাপতির গুরুত্ব সমান। যদিও পদমর্যাদায় এগিয়ে সভাপতি। এই প্রেক্ষিতে সুকান্তের বাড়তি কতগুলো ‘সুবিধা’ও আছে। প্রথমত, তিনি সরাসরি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)-এর লোক। অন্য কোনও দল থেকে নয়, পূর্বসূরি দিলীপ ঘোষের মতো সঙ্ঘ থেকেই তাঁর বিজেপিতে আগমন। দ্বিতীয়ত, সুকান্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। দলের রাজ্য সভাপতির চেয়ারে তাঁর মতো শিক্ষিত ব্যক্তির ‘কদর’ স্বাভাবিক ভাবেই বেশি। তৃতীয়ত, সুকান্ত উত্তরবঙ্গের জনপ্রতিনিধি। বাংলার রাজনীতিতে যার নজির খুব বেশি নেই। একদা এই বিজেপিরই রাজ্য সভাপতি ছিলেন তপন শিকদার। তাঁর আদি বাড়ি ছিল মালদহে। যদিও তপনের পরিচিতি দক্ষিণবঙ্গে রাজনীতি করার সূত্রেই। সব মিলিয়ে দিলীপের উত্তরসূরি হিসেবে দৌড়ে তৃণমূল সরকারের প্রাক্তন দাপুটে মন্ত্রী শুভেন্দুর চেয়ে খানিকটা হলেও এগিয়ে ছিলেন সুকান্ত। ইনস্টিটিউট হলে উপস্থিত নেতারা মনে করছেন, সেই এগিয়ে থাকাটাতেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আনুষ্ঠানিক সিলমোহরও পড়ে গেল। তাঁরা জানাচ্ছেন, বনশল এ কথা জানাতেই হাততালির আওয়াজে ফেটে পড়ে রায়গঞ্জের প্রেক্ষাগৃহ।
রবিবার থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা ঘুরছেন বনশল। শুরু থেকে শেষ— তাঁর পাশে ছিলেন সুকান্ত। বিজেপি সূত্রে খবর, মঙ্গলবার রায়গঞ্জের বৈঠক শেষ করে বনশল পাড়ি দেন দিল্লি। বুধবার সকালে কলকাতা ফিরবেন সুকান্ত। বৈঠকে উপস্থিত এক নেতার মতে, সুকান্তের মতো স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতার ওজনে অতিরিক্ত হিসাবে যোগ হয়েছে তাঁর উত্তরবঙ্গের সঙ্গে নাড়ির টানের কথা। প্রথম জীবনে দিনাজপুরেই সঙ্ঘের কর্মী হিসেবে কাজ যেমন করেছেন, তেমনই বিজেপিতে আসার পরও উদ্ভিদবিদ্যা (বটানি)-য় পিএইচডি সুকান্তের রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্র বদলায়নি। ঘটনাচক্রে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় উত্তরবঙ্গে বিজেপির উপস্থিতি অনেক বেশি প্রকট। এই পরিস্থিতিতে উত্তরবঙ্গের সুকান্তের চেয়ারে অন্য কাউকে বসানোর কথা যে গুরুত্ব পায়নি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে, মঙ্গলবার রায়গঞ্জের ইনস্টিটিউট হলে তা-ই স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন বনশল।
বিজেপির নিয়ম অনুসারে, পর পর দু’দফায় অর্থাৎ ছ’বছর কোনও ব্যক্তি রাজ্য সভাপতি থাকতে পারেন না। তাই ২০২১-এর সেপ্টেম্বরে মেয়াদ শেষের আগেই দিলীপকে সরিয়ে সুকান্তকে পদে আনা হয়েছিল। সুকান্ত-ঘনিষ্ঠেরা মনে করেন, বালুরঘাটের সাংসদকে টানা দু’দফায় সভাপতি রাখতে চান কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। ফলে বনশল পঞ্চায়েত ভোটের কথা বললেও রাজ্য বিজেপিতে সুকান্ত-ঘনিষ্ঠরা মনে করেন, ২০২৬-এর বিধানসভা ভোট পর্যন্ত সুকান্তই থাকবেন রাজ্য সভাপতি। আর সুকান্ত-শুভেন্দু জুটিকে মুখ করেই ভোটের লড়াই চালাবে গেরুয়া শিবির।