একজন ক’দিন আগেই কর্মক্ষেত্রে আমার ঘরে আমার এক ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘নতুন এই যে সরকার গঠন হল, তাদের উদ্দেশে তুমি কী বলতে চাও?’ এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে গড়গড়িয়ে বলে চলল মেয়ে, এতটুকু দ্বিধা না করে, ‘দেখুন, আমি চাই, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি সর্বত্রই ভর্তি কিংবা পরবর্তী চাকরির বিষয়ে সবসময় যেন মেধাভিত্তিক নিয়োগ হয়। আমরা ছাত্রছাত্রীরা চাই সুস্থ সুন্দর পরিবেশ, যে পরিস্থিতি বাড়ি থেকে পাড়ায়, পাড়া থেকে ছাড়িয়ে আমার স্কুলকেও প্রভাবিত করে, শিক্ষায় আঘাত করে, সে পরিবেশ কলুষমুক্ত হওয়া চাই।’
সচেতন ছাত্রী এরপর জল সংরক্ষণের ব্যাপারেও যথেষ্ট স্পষ্ট ভাষায় মানুষের ত্রুটির কথা, প্লাস্টিক অতিরিক্ত ব্যবহারের যে ক্ষতি সে প্রসঙ্গ তুলে ধরে। অবাক হয়ে ভাবি, ওরা কতটা সমাজ ও পারিপার্শ্বিক সচেতন। শুধু আমি নই, সকলেই বুঝতে পারেন, মানসিকতায় কতটা দৃঢ় হয়ে উঠছে ওরা, অভিজ্ঞতায় এগিয়ে চলেছে। আমাদের এ বয়সের কথা সঙ্গে সঙ্গে মনে এল ছবির মতো। ফিরে তাকিয়ে সত্তর আশির দশককে মিলিয়ে দেখতে দেখতে ভাবি, আমাদের এ ভাবে দাবি জানাতে হয়নি কোনওদিন। ভাবতে হয়নি সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু দ্বন্দ্বের বিষয়। সবাই ছিলাম একাকার। সঙ্কট ছিল দারিদ্রতার, বহুক্ষেত্রে। সে অন্য সঙ্কট। ছাত্রছাত্রী এতে বরং ভিতরে ভিতরে এক অন্য প্রতিজ্ঞায় নিজেদের গড়ে নিত। দাঁত মুখ চেপে পড়াশোনা করত নিজেরা খেটে। কোনও রকম প্রাইভেট টিউশনের তোয়াক্কা না করেই।
বদলে গেছে সময়। প্রতিদিন খবর কাগজের প্রথম পৃষ্ঠা, টিভির খবরে অভিভাবকদের আলোচনায় ওরা ছাত্রছাত্রীরা ক্রমশ কি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেছে! মেধাচর্চা, উন্নতির চেষ্টা কিংবা একসঙ্গে সাংস্কৃতিকতার স্বপ্ন, খেলাধূলার সামগ্রিক উদার পরিবেশ, স্কুল মাঠের সদ্ব্যবহার করার ইচ্ছে বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীর থাকে। কিন্তু সময় প্রধান নিয়ামক, নিয়ন্তা হয়ে ওঠে। ওরা কচি বয়সেই ওদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শুরু করছে। সাম্প্রতিক কালে রাজ্যের আনাচ কানাচে ধর্মের সুড়সুড়ি, হিংসা আর রক্তের ছবি দেখতে দেখতে ওরাও অবচেতনে স্থৈর্য হারিয়ে ফেলছে না তো! সুন্দর স্বপ্নমিনার যা সে ছোট থেকে তৈরি করেছিল, তাকে ভাঙতে দেখছে প্রতিনিয়ত। অস্পষ্ট ধোঁয়াশায় ভরছে পরের দিনরাতগুলো। সে ছাড়তে চাইছে নিজের রাজ্য। এ প্রবণতা গত আট দশ বছর ধরে চক্রাকারে বেড়েই চলেছে। বর্তমানে প্রথম দশে থাকা ছাত্র ছাত্রী মত দিচ্ছে ওরা বাইরে পড়তে চায়। এ কি আস্থাহীনতা! প্রতিদিন ওদের স্বপ্ন বুনতে দেখি, বাবা মায়ের চোখে দেখি আকুলতা। সহমর্মী, সমমর্মী হতে হতে অভিভাবকের চোখও বদলে যেতে দেখি, হতাশার দৃষ্টি লক্ষ করি, গলায় বাজে আশাহীনতার ছায়া। ভীত হই।
আকাশকুসুম স্বপ্নেরা বাঁচে না। কিন্তু প্রকৃত প্রয়োজনের সঙ্গে তুলনায় আয়োজন আছে তো! এই যে কোটি কোটি কোমলমতি অফুরন্ত স্বপ্ন চোখে স্কুল ছেড়ে যাচ্ছে উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্য যে শেষ পর্যন্ত সে প্রকৃত প্রয়োজনটুকু তার ভাল লাগাটুকু বেঁচে থাকবে তো! এ প্রশ্ন শুধু আমাদের মনেই ওড়াউড়ি করে তা নয়, ছাত্রছাত্রীর নিঃশব্দ হতাশ্বাসে ছড়িয়ে যায় অবসাদের আবছায়া অন্ধকার। উদাহরণ তো ছড়িয়েই পড়ছে, সেই সঙ্গে মস্তিষ্কের শিক্ষার উর্বরতার বদলে ইউটিউবে নানা ওয়েবে যন্ত্রণা উদ্রেককারী রকমারি মারণান্তক খেলা, জীবননাশকারী শিক্ষা ছাত্রছাত্রীর মাথার কোষে কোষে নেতিবাদী চিন্তার নিঃসরণ ঘটাচ্ছে। অবিলম্বে খেলার মাঠের প্রাবল্য, সাংস্কৃতিকতার সংযুক্তি ঘটালে হয়তো বেঁধে বেঁধে থাকার ইচ্ছেটা স্কুল চৌহদ্দি ছাড়িয়ে পৃথিবী দেখার দিনেও বিস্তৃত থাকবে।
আড্ডা তো বাঙালি ছেলেমেয়ের অবধারিত বিষয়ের মধ্যে পড়ে। গত কয়েক বছরে বদলে গিয়েছে আড্ডার ধরন। পাশাপাশি বসে ওরা আধো অন্ধকারে নীলচে আলো বিনিময় করে। কথাটথা সেসব মেসেজেই চলতে থাকে। নতুন এক ছায়াছবি। জীবন্ত প্রাণ অথচ নির্বাক সহযাপন। ক্লাস না করে হোয়াট্সঅ্যাপে নোটস্ নিচ্ছে, হাতে লিখে নেওয়া উঠে গিয়েছে সময় নষ্টের অছিলায়। ফলে পরিশ্রমের ধারা যেমন বদলেছে, পারস্পরিক আন্তরিকতার ও বদল ঘটেছে। পাশাপাশি বসে থাকা ক্ষুদে ছেলে মেয়েরা বন্ধুতো? কথা হারিয়ে শব্দ ভুলে ওরা পারিপার্শ্বিকের বানানো পুতুলে পরিনত হচ্ছে না তো!
আসলে অভিভাবককেও ওদের শিশুকাল থেকেই সচেতন হতে শেখানো দরকার। আমাদের চেনা কতগুলো ছোটবেলার বইয়ে এমন শিক্ষার কথা বলা থাকত যে তার অন্তর্নিহিত মর্মকথা আজ ও বয়ে নিয়ে চলি। সে তালিকায় ছোটদের রামায়ণ, মহাভারত তো বটেই, ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদার ঝুলি, ছোটদের পত্রপত্রিকা, সাম্প্রতিক কালে জনপ্রিয় অনুবাদ ছোটবেলা তৈরি করে দিতে দিতে আজও ভাবিয়ে চলেছে, ঠিকঠাক চলছি তো সকলকে নিয়ে!
রাজনীতি, সমাজনীতি, দেশের কথা ভাবার অবকাশ হারিয়ে ফেলছে ছাত্রছাত্রী, অথচ আমাদের ইতিহাস অন্য কথা বলে। তরুণসমাজ থেকেই উঠে এসেছিল সমাজ গড়ার আগ্রহ উদ্দীপনা, দেশকে স্বাধীন করার সবটুকু ইচ্ছের ফসল আমরা পেয়েছিলাম তৎকালীন ছাত্রছাত্রীর মেধা ও মননের হাত ধরেই। সেসব নানা শুভ ইচ্ছেকে তারা মন থেকে দূর করে দেয় প্রথমেই। সমাজ পরিবেশ তাদের সেই সমাজ সচেতন মনস্ক করে তুলতে পারছে না। বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে রাজনীতির প্রতি। পড়াশোনা, দারুণ রেজাল্ট, ধাপে ধাপে উচ্চ শিক্ষার স্তর পেরিয়ে এ মাটি ছেড়ে যেতে চাইছে কেন, সে কথা ও কারণ অনুসন্ধানের বোধ হয় সময় এসেছে। নতুন পরিবেশ, শুভবোধ যাতে আজকের ছাত্রছাত্রীর সমস্ত জীবনটাকেই বদলে দিতে পারে এবং সুবাতাস এসে সমস্ত অবসাদ দূর করে যেন বন্ধনমুক্ত, মানুষ খুঁজে দিতে পারে। সে দিকে তাকিয়ে আছি।
(লেখক সুনীতি অ্যাকাডেমির শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।