‘মহারাজ’ বলে কথা। ডাক পড়লে তবেই সন্দর্শনে যেতে হয়, নইলে নয়।
তেমনই ডাক পড়েছিল বসন্তের এক শেষ বিকেলে। কোচবিহার শহর থেকে জাতীয় সড়ক পার হয়ে বিরাট মাঠের মধ্যে তাঁর বাড়ির সামনে এসে যখন মোটরবাইক থামল, সূর্য ডুবু ডুবু। পরের কয়েক ঘণ্টার কথোপকথনে বারবার করে মনে হয়েছে, মহারাজের সূর্যও কি ডুবছে? নাকি তা মধ্যগগনে?
তিনি নিজেকে অবশ্য বলেন ‘গরিব মানুষ’। যা মনে পড়িয়ে দেয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সেই বিখ্যাত সংলাপ— ‘হাম তো ফকির আদমি হ্যায়, ঝোলা লেকে চল পড়েঙ্গে’। বিরাট চকমেলানো প্রাসাদোপম বাড়ি, বাইরে সিসি ক্যামেরা, স্বয়ংক্রিয় আধুনিক বন্দুক হাতে আধা সেনা। এই সব নিয়ে যে গরিব মানুষটি কোচবিহারের উপকণ্ঠে চকচকা শিল্পকেন্দ্রের পাশের জমিতে বাস করছেন এখন, তিনি গরিব শব্দটিকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেলেন, বাধ্য হয়েই সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হয়েছিল তাঁর সামনেই। বলতে হয়েছিল, যাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা করেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, যাঁর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চলে আসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনি গরিব মানুষই বটে!
শুনে স্বভাবসিদ্ধ ভাবে হেসেছিলেন তিনি। অনন্ত রায়, যাঁকে অনন্ত মহারাজ বলেই চেনে গোটা কোচবিহারের মানুষ।
তবে অমিত-সাক্ষাতে এ বারে বুঝি কিঞ্চিৎ ছন্দপতন ঘটেছিল প্রথমে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে শিলিগুড়িতে গিয়েছিলেন অনন্ত। সন্ধ্যায় দু’জনের দেখাও হয়। কিন্তু সেখানে তাঁর কথা শোনা হচ্ছে না, এই যুক্তিতে বেরিয়ে আসেন অনন্ত। কিছুটা রাগত ভাবেই। পরের দিন ফের বিজেপির তরফে চেষ্টা-চরিত্র করে দু’জনকে মুখোমুখি বসানো হয়। সেখানে অমিত তাঁকে দিল্লি যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান বলেও খবর।
এখন প্রশ্ন হল: প্রথমত, সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ, কী জাদুকাঠি আছে অনন্তের পকেটে? দ্বিতীয়ত, কী করে তিনি এই সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেন?
অনন্তের কথায়, তিনি রাজনীতির লোক নন। সকলের জন্যই তাই তাঁর অবারিত দ্বার। বসন্ত শেষের সেই সন্ধ্যায় তিনি জানিয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কতটা নিকট সম্পর্ক। তিনি জানিয়েছিলেন, সম্প্রতি নাতির জন্মদিনে মুখ্যমন্ত্রী উপহার পাঠিয়েছেন। বলেছিলেন, ‘‘উনি যখন চিলা রায়ের জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে এলেন, মঞ্চে কিন্তু ওর সঙ্গে কেউ ছিল না। উনি একাই মঞ্চে বক্তৃতা দিয়েছিলেন।’’
একই ভাবে বিজেপির সঙ্গেও তিনি সমান সম্পর্ক রেখে চলেন। বা বলা যায়, বিজেপি তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলে। তিনি বলেন, কী ভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে তিনি ‘ধাক্কা’ খেয়েছেন। তিনি জানান, কী ভাবে বংশীবদনকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। এখন সেই বংশীবদনই তাঁর বিরুদ্ধে, অনন্তের গলায় চাপা ক্ষোভ।
ক্ষোভ তাঁর রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধেও কিঞ্চিৎ রয়ে গিয়েছে। নাকি সেটা শাসকদলের বিরুদ্ধে? তাঁর বিরুদ্ধে যে রাজ্য প্রশাসন পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছিল, ফৌজদারি আইনে মামলা করা হয়েছিল, তার পিছনে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের কারও কারও ইন্ধন ছিল বলেই ধারণা অনন্তের। সে কথা খুব খোলাখুলি না হলেও ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেন তিনি।
বস্তুত, অনন্তকে নিয়ে শাসকদলে ঠিক দু’রকম ধারণা রয়েছে। তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশ মনে করেন, রাজবংশীদের মধ্যে অনন্তের বিশেষ প্রভাব নেই। শাসকদলের দুই যুযুধান শিবিরের দুই নেতাই এই ব্যাপারে এক সুরে কথা বলেন। তাঁরা পরিষ্কার প্রশ্ন করেন, এতই যদি জনসমর্থন হয়, তা হলে অনন্ত ভোটে দাঁড়ান না কেন? তাঁরা মনে করিয়ে দেন, এই রকম আলাদা রাজ্য এবং রাজবংশীদের লড়াকু নেতা হিসেবে পরিচিত বংশীবদনও একক চেষ্টায় ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তাঁর।
কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, অনন্তের প্রভাব যথেষ্ট। লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটে কোচবিহারে হারের পরে হয়তো দলনেত্রী সেই প্রভাবের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, এমন কথা মনে করেন কোচবিহারের অনেক তৃণমূল নেতাই। উল্টো দিকে, বিজেপির সঙ্গে বরাবর এই ধরনের
শক্তিগুলির যথেষ্ট সখ্য। বিশেষ করে যাঁদের উপরে রাজ্য প্রশাসনের চাপ রয়েছে। যেমন বিমল গুরুং। তেমনই অনন্ত মহারাজ। এই দু’জনের মধ্যে মিলও যথেষ্ট। দু’জনই আলাদা রাজ্য চান। এবং দু’জনই কোনও না কোনও সময়ে কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের মুখ চেয়ে বসে, কবে তাঁদের আলাদা রাজ্য দেওয়া হবে!
(চলবে)