সঙ্ঘাত ভুলছেন মমতা?
বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্প, ভর্তুকি, করের ভাগ এবং ক্ষতিপূরণ মিলিয়ে বাংলা দিল্লির থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত হিসাবে পায় ১ লক্ষ ৯৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় প্রকল্প বাবদই প্রাপ্য ১৭,৯৯৬ কোটি টাকা। কেন্দ্রের থেকে ওই বকেয়া অর্থ চাইতে গিয়ে শুক্রবার মোদীকে দেওয়া চিঠিতে মমতা লিখেছেন, ‘এই প্রকল্পগুলিতে রাজ্য সরকার কেন্দ্রের সমস্ত নির্দেশিকা মেনে চলছে। তারপরেও অর্থ না মেলায় প্রকল্প ব্যাহত হচ্ছে। গ্রামের মানুষ সঙ্কটে পড়েছেন।’
প্রকল্প চালাতে ‘কেন্দ্রের সমস্ত নির্দেশিকা’ মেনে চলার কথা বলেছেন মমতা। বিজেপি তথা কেন্দ্রের মূল অভিযোগ ছিল, নির্দেশিকা না মেনে প্রকল্পের নাম বদল করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। সেই কারণেই টাকা বন্ধ করা হয়েছে। এখন তাই মমতার কথায় ‘উজ্জীবিত’ বাংলার বিজেপি শিবির। দলের নেতারা মনে করছেন, সব ‘নির্দেশিকা’ মানার কথা উল্লেখ করে ওই সমস্ত প্রকল্পের নাম বদল না করার কথাই বলতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
বিজেপির অভিযোগ, মোট সাতটি কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম বদল করেছে রাজ্য সরকার। ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’-র নাম হয়েছে ‘বাংলা আবাস যোজনা’। ‘প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা’-র নাম হয়েছে ‘বাংলা গ্রাম সড়ক যোজনা’। এ ছাড়াও ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা’-র নাম ‘খাদ্যশ্রী’, ‘প্রধানমন্ত্রী জল যোজনা মিশন’-এর নাম রাজ্যে হয়েছে ‘জলস্বপ্ন’। এ ছাড়াও ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’, ‘ওয়াটার শেড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম’ এবং ‘ন্যাশনাল রুরাল লাইভলিহুড মিশন’-কে রাজ্যে ‘নির্মল বাংলা’,‘ জল ধরো-জল ভরো’ এবং ‘আনন্দধারা’ নামে চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ।
সেই অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি কিছুটা চাপেও পড়েছিল রাজ্য সরকার। নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছিল, বিভিন্ন প্রকল্পের নাম বদল নিয়ে প্রশ্ন তুলে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রক টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। গত জুন মাসে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক নবান্নকে একটি চিঠি পাঠায়। তাতে বলা হয়, আবাস যোজনায় ‘বাংলা’ মুছে ‘প্রধানমন্ত্রী’ না-লিখলে কেন্দ্র ওই প্রকল্পে আর টাকা দেবে না। একই সঙ্গে কেন্দ্রের নতুন প্রকল্প ‘আবাস প্লাস’ বাবদেও বাংলাকে কোনও টাকা দেওয়া হবে না।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সেই চিঠির আগে আগেই মমতা একটি অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন, এই বছরে আবাস যোজনার ‘টার্গেট’ এখনও কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়নি। এর পরে কেন্দ্র নবান্নকে পাঠানো চিঠিতে জানায়, রাজ্য বাংলার বদলে প্রধানমন্ত্রী শব্দটি ওই যোজনায় যুক্ত না করা পর্যন্ত নতুন ‘টার্গেট’ দেওয়া হবে না।
বিজেপির তরফে অভিযোগ ওঠার পরে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দল রাজ্যে আসে প্রকল্পগুলির পর্যালোচনা করতে। বিজেপি বলে, সেই সময়ে অনেক জায়গাতেই আবাস বা সড়ক যোজনার ফলকে ‘বাংলা’ লেখার উপরে ‘প্রধানমন্ত্রী’ স্টিকার মেরে দেওয়া হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে স্বয়ং মোদী ‘স্টিকার দিদি’ বলে মমতাকে আক্রমণ করেছিলেন। তবে তখন বা সাম্প্রতিক কালে এই বিষয়ে আদৌ নরম মনোভাব দেখায়নি তৃণমূল।
গত মে মাসেও এ নিয়ে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মমতা। গত ৩০ মে মমতা বলেছিলেন, ‘‘পাঁচ মাস এই টাকা বন্ধ রেখে নোংরা রাজনৈতিক খেলা খেলছে কেন্দ্রীয় সরকার। এটা আমাদের প্রাপ্য।’’ দলের কর্মীদের নির্দেশ দিয়ে মমতা বলেছিলেন, ‘‘কেন মানুষ ১০০ দিনের কাজের টাকা পাচ্ছেন না? ‘বিজেপি জবাব দাও, প্রধানমন্ত্রী জবাব দাও’, এই স্লোগানে গ্রাম ও শহরে এই আন্দোলন হবে।’’
তার পরে রাজ্যে সফরে এসে মমতার অভিযোগের জবাব দিয়েছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা। কলকাতায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘তিন বছর ধরে কেন্দ্রকে এই প্রকল্পের হিসাব পাঠায়নি রাজ্য। মমতাদিদি কি হিসাব দিতে ভুলে গিয়েছেন?’’ সঙ্গে সংযোজন, ‘‘যে কোনও প্রকল্পের টাকা পেতে গেলে সময়ে হিসাব দিতে হয়। কেন্দ্র যদি হিসাব না পেয়ে টাকা পাঠায়, তবে সেটা ভুল হবে। সেই ভুল করবে না কেন্দ্রীয় সরকার।’’
জুন মাসেও একটি সমাবেশে মমতা বলেছিলেন, প্রকল্পের নাম ‘বাংলা আবাস যোজনা’-ই থাকবে। ২৮ জুন বর্ধমানে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘যে কোনও রাজ্যের নিজের নামে বাড়ি থাকবে। গুজরাতে গুজরাতের নামে থাকবে। উত্তরপ্রদেশে যদি উত্তরপ্রদেশের নামে থাকতে পারে, রাজস্থানে যদি রাজস্থানের নামে থাকতে পারে, তাহলে বাংলার নামে থাকলে আপনাদের কিসের আপত্তি?’’ সঙ্ঘাতের আবহ ছিল তৃণমূলের ২১ জুলাইয়ের সমাবেশেও। সে দিনও মমতা আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। আর দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘কেন্দ্রের চাপে পড়ে আমরা মাথা নোয়াবে না। কেন্দ্র চেয়েছিল কেন্দ্রের নামে প্রকল্প করতে হবে। তবেই টাকা দেবে কেন্দ্র। কিন্তু অন্য দলগুলির মতো আমরা এই চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করিনি। আমরা বলেছি, বাংলার প্রকল্প হলে শুধু বাংলার নামেই হবে। বাংলা আবাস যোজনা হবে। বাংলা সড়ক যোজনা হবে। তাতে যদি কেন্দ্র টাকা না দিতে চায়, বাংলার সেই টাকা লাগবে না! বাংলা কেন্দ্রের ভরসায় ছিল না। থাকবেও না। বাংলাই নিজের রাস্তা নিজে বানাবে।’’
তবে রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, রাজনীতির মঞ্চ থেকে যে কথা বলা যায়, প্রশাসকের চেয়ারে বসে অনেক সময়েই তা বলা যায় না। সে কারণেই কেন্দ্রীয় প্রকল্প নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে ‘নরম’ মনোভাব দেখিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নের একটি সূত্রের বক্তব্য, রাজ্য সরকারের এখন টানাটানির সংসার। ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’, ‘স্বাস্থ্যসাথী’র মতো একগুচ্ছ কল্যাণ প্রকল্পের জন্য খরচ বেড়েছে। প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের বক্তব্য, পরিস্থিতি এতটাই কঠিন যে, অর্থ জোগানো কঠিন হচ্ছে পরিকাঠামো-সহ নানা ক্ষেত্রে।
এমন ‘কঠিন সময়ে’ যত দিক থেকে এবং যত বেশি করে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা আনা সম্ভব, সে দিকে নজর দিচ্ছে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষমহল। সেই লক্ষ্যেই কি প্রশাসনের প্রধান মমতাও শুধু সঙ্ঘাতের পথে না হেঁটে রাজ্যের স্বার্থে কেন্দ্রের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে চাইছেন? লিখিত ভাবে জানাচ্ছেন, কেন্দ্রের সমস্ত ‘নির্দেশিকা’ মেনে চলার কথা?