Correctional Home

বিভেদের আড়াল

সংশোধনাগারগুলিতে কোনও ভাবেই যাতে জাতপাতভিত্তিক বৈষম্য আচরিত না হয়, সেই লক্ষ্যে ‘মডেল প্রিজ়ন ম্যানুয়াল ২০১৬’ ও ‘মডেল প্রিজ়নস অ্যান্ড কারেকশনাল সার্ভিসেস অ্যাক্ট ২০২৩’ সংশোধন করা হয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ ০৪:৫২
Share:

একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকটির মাঝপথে এসেও যে রাষ্ট্র ও সমাজ-মানসিকতায় রয়ে গিয়েছে ঔপনিবেশিকতা ও পশ্চাৎপদতার নানা নমুনা, তা-ই আরও এক বার পরোক্ষ ভাবে ফুটে উঠল সরকারি ঘোষণায়। ঘোষণাটি অবশ্য এগিয়ে যাওয়ার, সংস্কারের। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দেশের সব রাজ্য সরকারকে জানিয়েছে, সংশোধনাগারগুলিতে কোনও ভাবেই যাতে জাতপাতভিত্তিক বৈষম্য আচরিত না হয়, সেই লক্ষ্যে ‘মডেল প্রিজ়ন ম্যানুয়াল ২০১৬’ ও ‘মডেল প্রিজ়নস অ্যান্ড কারেকশনাল সার্ভিসেস অ্যাক্ট ২০২৩’ সংশোধন করা হয়েছে। বিশেষ ভাবে বলা হয়েছে, সংশোধনাগারের মধ্যে নানাবিধ কাজ বা কর্তব্যের বরাদ্দে যেন কারাবন্দিদের মধ্যে কোনও রকম বিভেদ, বৈষম্য, শ্রেণিবিন্যাস ইত্যাদি না করা হয়, যা যা কাজ করার তা করতে হবে সবাইকেই।

Advertisement

দেখেশুনে মনে হতে পারে, এ আর নতুন কথা কী। সব কাজ সবাইকে তো করতে হবেই, বিশেষত কারাবন্দি অপরাধী অভিযুক্ত বা বিচারাধীন প্রত্যেককেই, এতে জাতিভেদের প্রসঙ্গ আসছেই বা কেন। এখানেই সমাজ-মানসিকতার অজ্ঞতা। সংশোধনাগারের ভিতরের জগৎ সম্পর্কে বহিঃসমাজের ভয় ঘৃণা শঙ্কা আতঙ্ক মেশানো এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করে, কারাবন্দিদের মানমর্যাদা ও বিশেষত মানবাধিকার নিয়ে বাইরের ভারতবর্ষ ন্যূনতম ভাবিত নয়। এই অপরিচয় ও অবহেলার আড়ালেই চারিয়ে যায় নানা বৈষম্য, যার একটা বড় অংশ জাতিভিত্তিক। গত বছর অক্টোবরে এক জনস্বার্থ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিল, দেশে অধিকাংশ সংশোধনাগারে প্রচলিত নিয়মেই জাতিভেদ ও বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, জেলের মধ্যে ঝাঁট দেওয়া, বাথরুম পরিষ্কার করার মতো কাজগুলি যাঁরা করেন তাঁরা তথাকথিত ‘নিচু জাত’-এর মানুষ, ‘উঁচু জাত’-এর বন্দিদের দেওয়া হয় রান্না, বাগান করা-সহ অপেক্ষাকৃত সম্মানের কাজ। উল্লেখ্য, মামলাকারীর বক্তব্যে উঠে এসেছিল অনেকগুলি রাজ্যের কথা, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গও একটি। এ কথা সত্য যে, তামিলনাড়ুর সংশোধনাগারে থেবর, নাদার, পাল্লার ইত্যাদি গোষ্ঠীর, কিংবা রাজস্থানের কারাবিধিতে মেথর গোষ্ঠীভুক্ত বন্দিদের বিরুদ্ধে যে বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ বহুচর্চিত, তা হয়তো বাংলায় হয় না, কিন্তু কারা-প্রশাসনের ঘেরাটোপে ও লোকচক্ষুর আড়ালে সেখানে বন্দিদের মানবাধিকার সম্পূর্ণ রক্ষিত হচ্ছে কি না তার খতিয়ান কে-ই বা রাখছে, কতটুকু!

গত বছর শীর্ষ আদালতের নির্দেশের সুবাদেই নতুন বছরে কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ। বিশেষ করে জেলের মধ্যে ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং’-এর কথাটি উঠে এসেছে: দেশ জুড়ে যে কাজটি আইনত নিষিদ্ধ অথচ এখনও ভারতীয় সমাজে তার উদাহরণ মেলে; সংশোধনাগারের অতিনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় যেন তা কদাপি না হয় তা বলা হয়েছে। এও মনে রাখার, কেন্দ্র আদর্শ কারাবিধি ও নির্দেশিকা প্রয়োগ করেছে বটে, কিন্তু রাজ্যে রাজ্যে সংশোধনাগারগুলির তদারকির কাজটি রাজ্য সরকারেরই। সেই কারণেই এক-এক রাজ্যের জনগোষ্ঠী, জাতি-বর্ণ-ধর্ম পরিচয়ের রাজনীতিও তাদের কারাবিধিতে প্রতিফলিত হয়। অপরাধী, অভিযুক্ত বা বিচারাধীন যে যা-ই হোন, সংবিধানে বলা মানবাধিকার ও জীবনের মর্যাদা প্রত্যেকের প্রাপ্য। কারান্তরালে শাসকেরই হাতে যেন সেই অধিকার লুণ্ঠিত না হয়, কিংবা বাইরের সমাজেও, তা নিশ্চিত করতে হবে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement