শাড়ি দেখাচ্ছেন বিক্রেতা। মির্জাপুরে অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়ের ছবি।
ফুলিয়ার তাঁতের শাড়ি, কিন্তু কেবল সুতির নয়। কখনও পলিয়েস্টার, কখনও মার্সেরাইজড কটন মিশিয়ে বোনা শাড়ি এ বার পিছনে ফেলে দিয়েছে চেনা তাঁতে-বোনা সুতির শাড়িকে। একটা কারণ অবশ্যই দাম। চারশো টাকা থেকে ২৪০০ টাকা দামের এই শাড়ি পুজোর বাজারের সিংহভাগ দখল করেছে, দাবি ব্যবসায়ী বীরেন বসাকের। ‘বাম্পার’ নামে বিকোনো ওই শাড়ির বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল, গাঢ় রঙের জমির উপরে চেকস।
আর একটু দামী শাড়ি ‘জামদানি কাটিং ওয়ার্কস’ পলিয়েস্টার অ্যাক্রেলিকে বোনা। দাম ১২০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকার মধ্যে। বীরেনবাবু জানান, জাকার্ড তাঁতে বোনা ওই শাড়িটি জামদানির ঢঙের হলেও, গাঢ় রঙের প্রাধান্য। এ সব শাড়িতে তাঁতের শাড়ির মতো দু’-একবার পরার পরেই ভাঁজ নষ্ট হওয়ার ভয় নেই। পলিয়েস্টার থাকায় দামি সিল্কের মতো ঝলমলে। সব মিলিয়ে বাজারে ‘সুপার হিট’ পলিয়েস্টার মেশোনো সুতির।
তাঁতে-বোনা সুতির শাড়িতেও অবশ্য এসেছে নতুনত্বের ছোঁয়া। বর্ধমানের কালনার তাঁতিরা জানিয়েছেন, পুজোর বাজারে বেশির ভাগ ক্রেতার চোখ টেনেছে তাঁতের জামদানি এবং রঙ্গাবতী শাড়ি। ক্রেতাদের এ বার পছন্দ হয়েছে দু’রঙা জামদানি, যার অর্ধেক গাঢ় রঙের, অর্ধেক হালকা রং। শাড়ির মধ্যে লতাপাতার নকশা। এমন জামদানি বিক্রি হয়েছে ১৪০০-২০০০ টাকায়। রংবাহারি রঙ্গাবতী শাড়িও ভাল চলেছে, দাম ১২০০-১৩০০ টাকা।
সমুদ্রগড় টাঙ্গাইল বস্ত্র ব্যাবসায়ী সমিতির সদস্য কার্তিক ঘোষ বলেন, ‘‘ক্রেতাদের এবার বেশি নজর ছিল দুটি শাড়ির উপরে।’’ সব বয়সীদের কথা ভেবে ওই দুই কাপড়ে রং এবং নকশার ব্যবহার করা হয়েছে, বলেন তিনি। তাঁর দাবি, ধাত্রীগ্রাম এবং সমুদ্রগড় এলাকার ট্র্যাডিশনাল ডবল শাড়ি তুলনায় বিক্রি কম।
সিল্কের শাড়িতে এ বার নতুনত্ব এনেছে মির্জাপুর। ‘মুর্শিদাবাদি সিল্ক’ বলে যা চলে, তার অধিকাংশ মির্জাপুরে তৈরি শাড়ি। এ বার পুজোর বাজার অনেকটাই দখল করেছে জাকার্ড ব্রোকেড। পাঁচ হাজার থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত দামের এই সিল্কের শাড়ির চাহিদা বিপুল। এ হল জাকার্ড তাঁতে বোনা রঙিন গরদ সিল্কের শাড়ি। আগে গরদের শাড়ি দখল করত সীতাহরণ, জটায়ু বধ, শকুন্তলাদের দৃশ্য। এখন নকশায় লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। সাদা সিল্কের সুতোকে বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে তার সঙ্গে থাকছে মিনার কাজ। বাজারে এই শাড়ি চলছে ‘‘জাকার্ড ব্রোকেড অল মিনা’’ নামে।
জাকার্ডের কারিগর হাতে গোণা, তাই চাহিদার সঙ্গে জোগানের তাল মেলাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাঁত শিল্পীদের। মির্জাপুরের ব্যবসায়ী গৌতম মনিয়া বলেন, ‘‘দু’বছর আগেও জামদানি, কাঁথা স্টিচ, আরি স্টিচ, নিমজরির বাজার ছিল মির্জাপুরে। এ বারে সেই সব শাড়ির চাহিদা নেই। রঙিন জাকার্ড মির্জাপুরের শিল্পীরাই তৈরি করেন। দামে বেশি হলেও মেয়েদের চোখ টানছে।’’
বিষ্ণুপুরের বালুচরী শাড়ির নকশা, রংমিলান্তিতেও পুজোয় থাকছে নতুনত্বের ছোঁয়া। ক্রেতারা সাবেকি বালুচরী থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেছিলেন বলে, নকশায় বৈচিত্র্য আনতে বিষ্ণুপুরের তাঁতে কয়েক বছর আগেই তৈরি হয়েছিল স্বর্ণচরী। এ বর সেই স্বর্ণচরী শাড়িতেও নতুনত্ব আনছেন কিছু শিল্পী। তাঁদেরই একজন বিষ্ণুপুরের তরুণ তাঁতশিল্পী অমিত লক্ষ্মণ। আসন্ন পুজোর কথা মাথায় রেখে সম্প্রতি তাঁর হাতে বোনা ‘দ্রৌপদী স্বর্ণচরী’ এল বাজারে। নিজের হাতে তৈরি দৌপদী শাড়িটি দেখাতে দেখাতে তিনি বলেন, “পিওর সিল্কের সঙ্গে এই শাড়িতে রেখেছি জরির সুতোর কাজ। শাড়ির ভিতরে গা জুড়ে রেখেছি আটটি চেন। যা একেবারে নতুন। পাড়ে থাকছে ছুটন্ত হরিণের নকশা।” চলতি স্বর্ণচরীর থেকে আর কিসে আলাদা এই শাড়ি? শিল্পীর জবাব, “কালার কম্বিনেশনে।” তিনি জানান, কালো রঙের উপর ১৫-২০ রকমের রঙের কাজ রাখা হয়েছে। এই শাড়িগুলোর দাম সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার আশেপাশে।
বিষ্ণুপুরের অমিতাভ পাল তাঁর তাঁতশাল থেকে নামিয়েছেন ‘মধুমালতী’ বালুচরী শাড়ি। যার সারা গায়ে ফুল ও লতা-পাতা। পাড়ের গায়ে তিনটি রঙে আদিবাসী গ্রামের লোকনৃত্যর ছবি। শাড়িটির অন্যতম বিশেষত্ব পিরামিড আকৃতির কিছু কাজ। সব মিলিয়ে এই শাড়ির গায়ে ব্যবহার হয়েছে ন’টি রং। অমিতাভ বলেন, “নকশার কাজ বেশি থাকায় দামও পড়ছে সাড়ে ৮ হাজার থেকে ১১ হাজার টাকা।” তিনি জানান, তাঁর দু’টি তাঁত থেকে ইতিমধ্যেই ৪৬টি শাড়ি বিক্রি হয়ে পুজোর বাজারে সমাদর পেয়েছে।