উড়ালপুল হয়নি, যানজটে ভোগান্তি

ঐতিহাসিক শহর বহরমপুর বরাবর কংগ্রেসের ‘গড়’। বামফ্রন্ট কিংবা তৃণমূল কেউই এই শহরের মন পায়নি। ওই দুই রাজনৈতিক শক্তির অশ্বমেধের ঘোড়া থমকে গিয়েছে ভাগীরথী পাড়ের বহরমপুরের দ্বারপ্রান্তে। তাতেই কপাল পুড়েছে বহরমপুরের। রেল দফতর গত ১৪ বছরে দু’ বার অর্থ বরাদ্দ করলেও শহরের প্রবেশপথের উপর উড়ালপুল নির্মাণ বিশ বাঁও জলে। রাজনৈতিক জেদের এই জাঁতাকলে পড়ে যানজটে ভোগান্তি এখন বহরমপুরের বাসিন্দাদের রোজনামচা।

Advertisement

অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৪ ০০:৫৫
Share:

নিত্যদিনের ভোগান্তি। চুঁয়াপুর রেলগেটে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

ঐতিহাসিক শহর বহরমপুর বরাবর কংগ্রেসের ‘গড়’। বামফ্রন্ট কিংবা তৃণমূল কেউই এই শহরের মন পায়নি। ওই দুই রাজনৈতিক শক্তির অশ্বমেধের ঘোড়া থমকে গিয়েছে ভাগীরথী পাড়ের বহরমপুরের দ্বারপ্রান্তে। তাতেই কপাল পুড়েছে বহরমপুরের। রেল দফতর গত ১৪ বছরে দু’ বার অর্থ বরাদ্দ করলেও শহরের প্রবেশপথের উপর উড়ালপুল নির্মাণ বিশ বাঁও জলে। রাজনৈতিক জেদের এই জাঁতাকলে পড়ে যানজটে ভোগান্তি এখন বহরমপুরের বাসিন্দাদের রোজনামচা।

Advertisement

প্রায় দু’শো বছর আগে পূর্বরেলের লালগোলা-শিয়ালদহ লাইনটি পাতা হয় শহর বহরমপুরের পূর্বপ্রান্ত বরাবর। এই শহরেরই কাশিমবাজার এলাকা দিয়েও চলে গিয়েছে রেললাইনের আরও কিছুটা অংশ। শহরে ঢুকতে চঁুয়াপুর ও এক কিলোমিটার দূরের পঞ্চাননতলা মিলে মোট ২টি রেলগেট পার হতে হয়। কাশিমবাজার স্টেশনের দু’ প্রান্তের ২টি রেলগেট রয়েছে শহরের বুকের উপর। ১৯৬০ সাল নাগাদ বারাসাত এলাকার আমডাঙা থেকে শুরু করে উত্তর দিনাজপুরের ডালখোলা পর্যন্ত ৪২১ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক নির্মাণ করা হয়।

বহরমপুরের উপর দিয়ে ওই জাতীয় সড়ক চলে গেলেও পঞ্চননতলা রেলগেট থেকে শুরু করে শহরের ভিতরের বাস টার্মিনাস পর্যন্ত এক কিলোমিটার রাস্তা জাতীয় সড়কের অন্তর্ভূক্ত নয়। প্রায় ৫ দশক আগে পঞ্চাননতলা রেলগেটের উপর উড়ালপুল তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পরিকল্পনা অনুসারে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক তৈরি করার সময় পঞ্চাননতলা রেলগেটের দু’ প্রান্তে উঁচু করে মাটি ফেলা হয়। কিন্তু তৈরি হয়নি উড়ালপুল ও প্রস্তাবিত উড়ালপুল লাগোয়া ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ‘লিঙ্ক রোড’।

Advertisement

রেলের শিয়ালদহ বিভাগের লালগোলা-কৃষ্ণনগর শাখায় ২৪ ঘণ্টায় মোট ১৮ জোড়া ট্রেন চলে। বহরমপুরের পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্য বলেন, “সেই কারণে ২৪ ঘণ্টায় মোট ৩৬ বার রেলগেট বন্ধ থাকে। তখন এক কিলোমিটার ব্যবধানে থাকা চোঁয়াপুর ও পঞ্চাননতলার রেলগেটের দু’ প্রান্তে ২৪ ঘণ্টা যানজট লেগে থাকে।” গাড়ি ও অন্যান্য যানবাহনের সারি পৌঁছে যায় পশ্চিমে ভাগীরথী সেতু ছাড়িয়ে ৩ কিলোমিটার দূরে পূর্বরেলের কাটোয়া-আজিমগঞ্জ শাখার নওদাপাড়া রেলগেট পর্যন্ত। পূর্ব দিকে যানজট পৌঁছয় ভাকুড়ির মোড় পার করে বলরামপুর পর্যন্ত। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের হিসাবে, পঞ্চাননতলা এলাকা দিয়ে দৈনিক ১০ হাজার গাড়ি চলে। তার উপরে রয়েছে মোটরবাইক, রিকশা, টুকটুক ও সাইকেল। ফলে যানজটের বহর সহজেই অনুমেয়।

পঞ্চাননতলা রেলগেটের উপর উড়ালপুল নির্মাণের দাবিতে দুই দশক ধরে আন্দোলন করছে ‘ডিস্ট্রিক্ট মুর্শিদাবাদ রেলওয়ে প্যাসেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন’। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফ খান বলেন, “পঞ্চাননতলা রেলগেটের উপর উড়ালপুল নির্মাণের জন্য ১৯৯৯ সালে রেল ৯৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে রাজ্যকে দিতে বলে মাত্র ১ লক্ষ ৯২ হাজার টাকা। কয়েক বছর ধরে সেই টাকা না দেওয়ায় ২০০৫ সালে এবং ২০০৭ সালে রাজ্যের তত্‌কালীন মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে আমরা লিখিত আবেদন করি। কিন্তু সেই আবেদনে সাড়া মেলেনি।”

২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের মাস দেড়েক আগে মুর্শিদাবাদের মণিগ্রাম স্টেশনে রেলের অনুষ্ঠানে আসার কথা ছিল তত্‌কালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। কপ্টারের যান্ত্রিক ‘গোলযোগ’-এর কারণে প্রণববাবু আসতে পারেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষ ট্রেনে মণিগ্রাম পৌঁছন। বহরমপুর টাউন কংগ্রেস সভাপতি অতীশ সিংহ বলেন, “উড়ালপুলের দাবিতে আগাম জানিয়ে রেল অবরোধ করা হয়েছিল। তবুও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে রেলমন্ত্রীর নির্দেশে আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।” তারপরেও উড়ালপুল হয়নি। ২০১২ সালের ২৮ অক্টোবর অধীর চৌধুরী রেলের প্রতিমন্ত্রী হন। তিনি চোঁয়াপুর ও পঞ্চাননতলায় ওই দুটি উড়ালপুল নির্মাণের জন্য মোট ৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন।

অতীশ সিংহ বলেন, “পুনর্বাসনের আশ্বাস পেয়ে উড়ালপুল নির্মাণের জন্য চোঁয়াপুর রেলগেটের দু’ পাশের মোট ১৬৩ জন ব্যবসায়ী তাঁদের দোকানঘর ভেঙে নেন।” তত্‌কালীন প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী ২০১৩ সালের ১৫ অগস্ট প্রস্তাবিত উড়ালপুলের শিলান্যাস করেন। ঠিকাদারও নিয়োগ করা হয়।

এরপরেও গেরো! অধীর চৌধুরী বলেন, “রাজ্যের নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) পেতে উড়ালপুল ও লিঙ্ক রোড নির্মাণের নকশা রাজ্যের পূর্ত দফতরে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু বহরমপুর, তথা মুর্শিদাবাদের মানুষ তৃণমূলকে পাত্তা দেয় না বলেই তাঁদের ‘সবক’ শেখাতে আজও এনওসি দেয়নি প্রতিহিংসা পরায়ণ সরকার।”

পূর্ত দফতরের প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী তৃণমূলের সুব্রত সাহার বাড়ি চোঁয়াপুর রেলগেট লাগোয়া এলাকায়। সুব্রতবাবু বলেন, “জঙ্গিপুরে প্রণববাবুর চেষ্টায় একটা উড়ালপুল তৈরি হয়ে দীর্ঘ দিন পড়েছিল বামফ্রন্ট সরকার লিঙ্করোড না করায়। পূর্ত দফতরের প্রতিমন্ত্রী থাকার সময় ওই লিঙ্করোড করে উড়ালপুল চালু করে দিয়েছি। চোঁয়াপুরে উড়ালপুল তৈরি থাকলে লিঙ্করোড তৈরি করে দিত রাজ্যই। কিন্তু উড়ালপুলই তো হয়নি।”

তৃণমূল যুব কংগ্রেসের মুর্শিদাবাদ জেলা সভাপতি অশেষ ঘোষ অবশ্য বলেন, “রাজ্য সরকারের এনওসি নিয়ে শিলান্যাস করতে হয়। সরকারি সেই নিময় কানুন না মেনে ভোটের চিন্তায় শিলান্যাস করায় উড়ালপুল আটকে আছে।” উড়ালপুল যে সত্যিই ভোটের খোরাক সে কথা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সভাপতি মুকুল রায়। বহরমপুর পুরভোটের প্রাক্কালে এফইউসি মাঠের জনসভায় মুকুল রায় বলেছিলেন, “বহরমপুর পুরসভা আমাদের হাতে তুলে দিন। তার ৬ মাসের মধ্যে আমরা উড়ালপুল তৈরি করে দেব।” পুরসভা পায়নি তৃণমূল। উড়ালপুলও হয়নি।

কয়েক মাস আগে বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী বিধানসভার অধিবেশন তোলপাড় করলে উড়ালপুলের নথিপত্র চেয়ে নিয়ে আশ্বাস দিয়েছিলন স্পিকার স্বয়ং। ব্যাস ওই আশ্বাসটুকুই সার!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement