নবদ্বীপের দোল উৎসব। — ফাইল চিত্র।
চৈতন্যধামে দোলের ভোল যে এমন ভাবে বদলে যাবে, কে জানত! তেরো পার্বণের নবদ্বীপে দোল উৎসব অনেক দিন ধরেই স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে উপস্থাপনার ‘প্রসাদ’ গুণে। একটা উৎসবকে ঘিরে এমন প্রসাদের আয়োজন বিরল। দোলের নবদ্বীপের পথে পথে সাজানো রইল হরেকরকম সুখাদ্য। বহিরাগত পর্যটক বা স্থানীয় মানুষ। শুধু এক বার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই হল। অমনি হাতে চলে আসবে খিচুড়ি, সব্জি, আলুরদম, লুচি, পোলাও, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি। কোথাও বসিয়ে খাওয়ানো, কোথাও আবার পাত্রে করে হাতে হাতে দেওয়া হচ্ছে খাবার। সকাল থেকে রাত মানুষকে পেট ভরে সুস্বাদু প্রসাদ খাইয়ে দোলযাত্রা উদ্যাপন নবদ্বীপের নতুন প্রবণতা। নাম দেওয়া হয়েছে ‘মহাপ্রভু ভান্ডারা।’
অন্য সব জায়গায় দোলের সকাল যখন নিছক একটা রঙিন ছুটির দিন, নবদ্বীপে সেটি শহরের সব চেয়ে বড় উৎসবের শেষ দিন। দোল পূর্ণিমায় চৈতন্যদেবের আবির্ভাব তিথিতে তাঁর জন্মভূমি নবদ্বীপে লাখো মানুষের ভিড় উপচে পড়ে। ঘরের ছেলের জন্মতিথি উদ্যাপনে যত অতিথি সমবেত হন, তাঁদের খাওয়ার দায়িত্ব এ দিন স্বেচ্ছায় আপামর শহরবাসী। ফলে, দোলের সকালে রং খেলার হুল্লোড়ের বদলে ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবি পরে ভান্ডারা সামলাতেই বেশি পছন্দ করছে নবদ্বীপ।
ইষ্টদেবতাকে ভোগ নিবেদনের পর প্রসাদ হিসাবে তা ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করাই রীতি। দুর্গা, কালী বা সরস্বতী, বিশ্বকর্মা পুজোয় পাত পেড়ে প্রসাদ খাওয়ানো উৎসবের অনিবার্য অঙ্গ বলেই বিবেচিত। মঠ-মন্দিরের শহর নবদ্বীপের এই অভ্যাস আরও প্রবল। বৈষ্ণব মন্দিরের যে কোনও উৎসব সমাপ্ত হয় ‘মোচ্ছবে’। সোজা কথায়, সকলের পঙ্ক্তিভোজনে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে দোলের নবদ্বীপে মঠ-মন্দির ছাড়াও প্রসাদ বিতরণের এক নতুন প্রবণতা তৈরি হয়েছে। ‘মহাপ্রভু ভান্ডারা’ নামে পরিচিত প্রসাদ বিতরণের ওই নতুন ধারা ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। আয়োজনে থাকেন কখনও পাড়ার লোকেরা, কখনও ব্যক্তিগত উদ্যোগ, কখনও কোনও ক্লাব বা সংগঠনের উদ্যোগে ভান্ডারার আয়োজন হয়। অতিমারির কারণে মাঝে কয়েক বছর তাতে ভাটা পড়লেও এ বারের দোল যেন সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে।
দোল উপলক্ষে নবদ্বীপে ভিড় করেন লাখো মানুষ। পায়ে পায়ে তাঁরা ঘুরে বেড়ান চৈতন্যস্মৃতি বিজড়িত প্রাচীন এই জনপদের গলি থেকে রাজপথ। দোলের দিনএবং পরের দিন শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে সেই সব বহিরাগত মানুষের জন্য প্রসাদ বিতরণের বিপুলআয়োজন হল মহাপ্রভু ভাণ্ডারা। প্রসাদ থেকে বাদ পড়েন নাস্থানীয় মানুষরাও।
যত দূর জানা গিয়েছে, দুই হাজার সালের দোলে এমন ব্যবস্থা প্রথম নিয়েছিলেন নবদ্বীপ বড়ালঘাটে ব্যবসায়ী মলয় কুণ্ডু। সে বার তিনি ব্যক্তিগত ভাবে দোলের দিন পথচলতি মানুষের জন্য প্রসাদের আয়োজন করেন। সেই শুরু। ক্রমশ শহরের প্রায় সব পাড়া জুড়ে শুরু হয়ে যায় ভান্ডারা। শহরের প্রায় সব বাজার কমিটি কিংবা ওষুধ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিসিডিএ-র নবদ্বীপ শাখা বড়-সড় ভাণ্ডারার আয়োজন করেছিলেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ভান্ডারা শুরু হয়েছে দোলের নবদ্বীপে। বিষ্ণুপ্রিয়া হল্টে নেমে নবদ্বীপ পা রাখতেই বহিরাগতদের হাতে প্রথম ভাণ্ডারার প্রসাদ তুলে দেন প্রবীর দেবনাথ।
তবে দীর্ঘ দিন ধরে সবচেয়ে বড় আয়োজন করেন নবদ্বীপের বিধায়ক পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা। নবদ্বীপের প্রবেশ পথ গৌরাঙ্গ সেতুর উপরে তিন দিন ধরে চলমান গাড়ির যাত্রীদের হাতে স্বেচ্ছাসেবকেরা তুলে দেন পাত্রে সাজানো পুষ্পান্ন, আলুরদম ও পায়েস। এ বারে তিন দিনে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষকে প্রসাদ দেওয়া হয়েছে। এতটা না হলেও কোনও ভাণ্ডারাতেই পাঁচ-সাতশো মানুষের কম প্রসাদের আয়োজন থাকে না।
খিচুড়ি, সব্জি, আলুরদম, লুচি, পোলাও, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি থেকে চা-কফি, বিস্কুট, সরবত সব বিনামূল্যে মেলে মহাপ্রভু ভাণ্ডারায়। মঙ্গলবারের পর বুধবারেও নবদ্বীপ বহু জায়গায় ভাণ্ডারার আয়োজন করা হয়। জানা গিয়েছে, ছোট-বড় মিলিয়ে দুই দিনে নবদ্বীপ ভাণ্ডারার সংখ্যা প্রায় দুশো ছুঁই-ছুঁই।