গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
নিমন্ত্রণবাড়ি থেকে বেরোতে রাত তখন প্রায় ১০টা। কৃষ্ণনগর স্টেশন সংলগ্ন রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন তুফান বিশ্বাস। আলো-আঁধারি ঘুপচি গলি পার হতে গিয়েই ঝটকা! উল্টো দিক থেকে হুশ করে আসা মোটরসাইকেলের পিছনের সিটে বসা লোকটি প্রায় ছোঁ মেরে তুফানের হাত থেকে মোবাইল তুলে নিয়েছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অন্ধকার গলি ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় মিলিয়ে গেল বাইকটি। কাউকে চেনার উপায় নেই। ধরারও সম্ভাবনা নেই। এই ভাবেই একের পর এক ফোন ছিনতাই হচ্ছে নদিয়ার বেশ কিছু জায়গায়। আর এই চোরা মোবাইল পাচার হচ্ছে বাংলাদেশে।
বন্ধুদের পরামর্শে রেলপুলিশের কাছে মোবাইল হারানোর অভিযোগ করেছিলেন তুফান। বিশেষ অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে আইএমইআই নম্বর দিয়ে চুরি যাওয়া মোবাইলের অবস্থান জানার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন। যদিও ছিনতাইয়ের পর থেকেই বন্ধ পাচ্ছিলেন ফোন।
মাস দেড়েক পর এক দিন হঠাৎই ফোনের ‘অবস্থান’ জানতে পারলেন তুফান। চুরি যাওয়া মোবাইলের ‘লোকেশন’ দেখলেন বাংলাদেশের মেহেরপুর! সঙ্গে সঙ্গে রেলপুলিশ এবং পুলিশের সাইবার সেলে অভিযোগ জানান কৃষ্ণনগরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ওই বাসিন্দা। পেশায় বেসরকারি কর্মীকে পুলিশের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় পড়শি দেশ থেকে ফোন উদ্ধার সম্ভব নয়। প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতার সাক্ষী বাংলাদেশের ঢাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গির শেখও। তাঁর চুরি যাওয়া মোবাইলের বর্তমান ‘লোকেশন’ নদিয়া জেলার চাপড়া থানা এলাকা। তিনি বিষয়টি নিয়ে দিল্লির হাই কমিশন এবং ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস পর্যন্ত গিয়েছেন। এমন বেশ কয়েকটি অভিযোগের পর বাংলার পুলিশ, বিএসএফ থেকে বাংলার বিজিবি এবং ডিবি তদন্তে নেমে দুই দেশেরই কয়েক জন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশে চুরি যাওয়া মোবাইলের বদলে পশ্চিমবঙ্গে চুরি করা মোবাইল বিনিময় করে চলছে ওই চক্র। সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে আইনি ঝামেলা থেকে বাঁচতে টাকার বদলে ফোন বদলাবদলি হয় বলে পুলিশ সূত্রে খবর।
ভারতে তৈরি হওয়া দামি স্মার্টফোনের বাংলাদেশে ব্যাপক চাহিদা। তাই এখান থেকে ছিনতাই করা মোবাইল বাংলাদেশে বিক্রি করে প্রচুর লাভ করে পাচারকারীরা। অল্প সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত মুনাফার জন্য পাচারকারীদের ‘পছন্দের তালিকায়’ রয়েছে এই মোবাইল ‘বিনিময় প্রথা’। কারণ, বাংলাদেশের ছিনতাইকারীরা একই ভাবে পাচারকারীদের মাধ্যমে ভারতে পৌঁছে দেয় সে দেশের আমজনতার পকেট কেটে চুরি করা মোবাইল। বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত বহুমূল্যের কিছু ফোন আবার ভারতের বাজারে ‘হট কেক’।
বিএসএফের একটি সূত্রে খবর, ভারতে চুরি যাওয়া মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর ধরে লোকেশন ‘ট্র্যাক’ করলে যে কোনও মুহূর্তে তার অবস্থান জানা সম্ভব। কিন্তু সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে বাংলাদেশে কোনও ফোন পৌঁছে দিলে কোনও থানার পুলিশের পক্ষে তা উদ্ধার করা সম্ভব নয়। তাই ও পার বাংলায় বিক্রি করা হচ্ছে ফোনগুলি। ঠিক একই কারণে বাংলাদেশে থেকে এ দেশে পাচার করা হচ্ছে চুরি করা মোবাইল। আর এগুলোর বিক্রি মূলত সীমান্ত লাগোয়া বাজারগুলিতে।
কিছু দিন আগে বিএসএফের ১১৫ নম্বর ব্যাটালিয়নের জওয়ানেরা পাচারের আগে ৩২টি মোবাইল বাজেয়াপ্ত করেছে। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, ও পার থেকে আসা মোবাইলের বিনিময়ে এই মোবাইলগুলি কাঁটাতারের উপর দিয়ে ছুড়ে ও পারে পাচারকারীদের হাতে দিয়ে দিয়েছিল চোরা কারবারিরা।
সীমান্ত পেরিয়ে চুরি যাওয়া মোবাইলের বিনিময় রুখতে বিএসএফ তথা দুই দেশের প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিয়েছে? ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিবি (সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অর্গানাইজ় ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার) বলেন, ‘‘মোবাইল পাচার একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ। আমরা অভিযান চালিয়ে নয় ভারতীয় পাচারকারিকে গ্রেফতার করেছি। তাদের কাছ থেকে নথিপত্রবিহীন একশোর বেশি ভারতীয় মোবাইল উদ্ধার হয়েছে। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মোহাম্মদ রসুল শেখ নামে এক বাংলাদেশি নাগরিককেও গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ দ্রুত এই চক্রের পাণ্ডাকে গ্রেফতার করা যাবে বলে তাঁরা আশাবাদী। আর বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের ডিআইজি একে আর্য বলেন, ‘‘এই রকমের অপরাধ প্রবণতার খবর সামনে আসতেই জওয়ানদের আরও বেশি করে সতর্ক করা হয়েছে। কিছু দিন আগে অল্পের জন্য কয়েক জন পাচারকারী পালিয়ে যায়। সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে পাচার শূন্যে নামিয়ে আনতে বিএসএফ বদ্ধপরিকর।’’