জলের জার।
জলের বোতলের গায়ে কোম্পানির নাম যাই লেখা থাকুক না কেন! অলিখিত একটা ছাপ রয়েছে, যা চোখে দেখা যায় না, সেটা হল—‘স্টেটাস’। লোকজন বেশ গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘‘আমরা তো জল কিনে খাই গো...।’’
এ যেন দু’ চাকা থেকে চার চাকায় উত্তরণের মতো! বহরমপুরের প্রাণকেন্দ্রে ফ্ল্যাট রয়েছে বিপ্লব ইকবালের। পেশায় শিক্ষক ওই যুবকের স্ত্রীও শিক্ষিকা। তাঁদের আরও মেশিন কেনার মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা রয়েছে। কিন্তু ২০লিটার জলের জারে ভরসা রাখেন ওই দম্পতি। লিফটে চড়ে চার তলায় পৌঁছে জলের জার ঘাড়ে কলিং বেল টিপে সপ্তাহান্তে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যান এক কর্মী। জারের জলপানে কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, ‘‘এর মধ্যে একটা সন্তুষ্টি রয়েছে। আরও মেশিন কেনা মানেই সারা বছরের দেখভাল করার জন্য আলাদা টাকাও লাগবে। সেই কোম্পানীর কর্মী ঠিক সময়ে না এলে ফোন করে ডেকে পাঠানোর হ্যাপা সামাল দিতে রাজি নই।’’
বহরমপুর গোরাবাজার আইসিআই স্কুলের প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত দত্ত বলছেন, ‘‘বাড়িতে জলের জন্য আরও-মেশিন লাগানো রয়েছে। অথচ ট্রেনে-বাসে যাত্রা করার সময়ে বাড়ি থেকে নয়, জলের বোতল কিনে খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে আমাদের অনেকের। আমার মনে হয় এর মধ্যে একটা দেখনদারি ব্যাপার রয়েছে। জলের বোতল বিক্রি করছেন, তাঁকে ডেকে সকলের সামনে টাকা বের করে ঠাণ্ডা জল কেনার মধ্যে কোথাও আত্মসন্তুষ্টি কাজ করে। তেমনি নিজের স্টেটাসও তুলে ধরার প্রবণতা কাজ করে বলে আমার মনে হয়।’’
বহরমপুরের আইনজীবী পীযুষ ঘোষ বলছেন, ‘‘জলবাহিত রোগ থেকে বাঁচতেই মানুষের জলের বোতল বা জারে ভর্তি পানীয় জলে ভরসা রাখছেন একশ্রেণির মানুষ। কিন্তু তাঁরা জানেন না ওই জল কতটা নিরাপদ! এর মধ্যে একটা মানসিক ব্যাপার কাজ করে, যার মধ্যে ‘ জল কিনে খাচ্ছি মানেই সেই জল পরিস্রুত এবং শরীরের পক্ষে তা ক্ষতিকারক নয়’ গোছের ধারণা কাজ করে। এর মধ্যে দেখনদারি তো রয়েছে বলেই আমার ব্যক্তিগত মত।’’
গত কয়েক বছর থেকে শহর ছাড়িয়ে গ্রামে গ্রামে ছোট ছোট জল প্রস্তুতকারক সংস্থা গড়ে উঠেছে। আর ২০ টাকার বিনিময়ে সেই জল গাড়ি করে বাড়ি পৌছে দিচ্ছে ওই জল প্রস্তুত কারক সংস্থার লোকজন। আবার প্রকল্পে গিয়ে জল কিনলে ১০ টাকায় কুড়ি লিটার জল পাওয়া যাচ্ছে। ফলে লোকজন সেই জল কিনে নিয়ে চলে আসছেন। যার ফলে ফিল্টারের হ্যাপা এড়ানো লোকজন জল কিনছেন। কিন্তু একবারও ভাবছেন না সেই জল আদৌও পরিস্রুত কিনা।
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের প্রধান রঞ্জন ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘জলবাহিত রোগ থেকে বিভিন্ন অসুখ হচ্ছে—এমন ফোবিয়া বা আতঙ্ক থেকেই মানুষ জলের বোতল বা কেনা জল কিনে খাওয়ার মধ্যে একটা দেখনদারি ব্যাপারটা অবশ্যই কাজ করে। কিছু ক্ষেত্রে নার্সিসিজম বা হিস্ট্রিয়োনিক ব্যক্তিত্ব সংঘাতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’’