মৎস্যজীবীদের কপালে আশঙ্কার ভাঁজ। —নিজস্ব চিত্র।
বর্ষা আসার আগে থেকেই সাজ সাজ রব পড়ে যেত ফরাক্কা থেকে শান্তিপুর— ভাগীরথীর দুই পারে বাস করা কয়েক হাজার মৎস্যজীবী পরিবারের মধ্যে। মাছ ধরতে নামার আগে সেরে রাখা হত নৌকা সারানো, জাল বাঁধা-সহ নানা কাজকর্ম। সব মিলিয়ে দম ফেলার ফুরসত থাকত না মৎস্যজীবীদের। এর পর বর্ষা নামলেই আশায় বুক বেঁধে নৌকা সাজিয়ে গঙ্গায় নেমে পড়তেন মৎস্যজীবীরা। তাঁদের সারা বছরের খোরাক জোগাত ভাগীরথী। কিন্তু এ বার উলটপুরাণ।
বর্ষার ভরা মরসুমে গাঙ্গেয় উপত্যকায় সে ভাবে দেখা নেই বৃষ্টির। ব্যারেজের ছাড়া জলে নদী খানিক পুষ্ট হলেও, দু’পারের হাজার হাজার মৎস্যজীবীদের হতাশ করেছে ভাগীরথী। দেখা নেই রুই ,কাতলা, কালবাউস, আড়, রিঠা মতো সাবেকি মাছের। পাওয়া যাচ্ছে না রুপোলি শস্য ইলিশেরও।
মৎস্যজীবীদের একাংশের দাবি, ভাগীরথীর দুই পারে, অপরিকল্পিত ভাবে শহর এবং বাজার গজিয়ে উঠেছে। সেখানকার সমস্ত বর্জ্য এসে পড়ছে গঙ্গার জলে। তার ফলে জলদূষণ হচ্ছে বলে অভিযোগ। এর জেরে গত দু’বছরের মধ্যে যে সংখ্যক মাছ মারা গিয়েছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জেলা মৎস্য বিভাগ নতুন করে মাছ ছাড়েনি বলেও অভিযোগ উঠেছে।
গত ৫০ বছরে ধরে নদিয়ার নবদ্বীপে মাছ ধরছেন রবিন হালদার। ভাগীরথীর সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কথা জানালেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘অন্য বার ভাগীরথীর বুকে এক বার জাল ফেললে ৫-৬ কেজি ওজনের বড় বড় রুই, কাতলা বা কালবাউস উঠত৷ আর বর্ষার ভরা মরসুমে এক কেজি থেকে দেড় কেজির ইলিশের আনাগোনা ছিল সাধারণ ব্যাপার! কিন্তু এখন সে সবের দেখা মেলে না।’’
দূষণের কথা মেনে নিয়েছেন নদিয়া জেলার মৎস্য আধিকারিক সুরজিৎ বাগ। তিনি বলেন, ‘‘দূষণজনিত কারণে মাছের বংশবিস্তারে কিছু সমস্যা হচ্ছে। আরও কিছু সমস্যা রয়েছে সেগুলি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।’’
মাথার উপর সঙ্কটের ভার ক্রমশ চেপে বসছে ভাগীরথীর দু’পারে বাস করা মৎস্যজীবীদের। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র ‘কুবের-যদু’র লড়াইয়ের জলছবি এখন নদিয়া-মুর্শিদাবাদের হাজার হাজার মৎস্যজীবীর জীবনের প্রতিচ্ছবি। অতীতের সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির তুলনা টেনে বহরমপুর কৃষ্ণমাটি এলাকার মৎস্যজীবী রঘু হালদার শোনালেন অনেক দিন আগে ৫০ কেজিরও বেশি বাঘা আড় মাছ ধরার ঘটনা। তিনি বলেন, ‘‘এপ্রিল মে মাস থেকে টানা অক্টোবর পর্যন্ত বেমুস, ভেটকি, তোপসে, বাতাসি, বোয়াল, চিতল, ট্যাংরার মতো মাছ জাল ফেললেই ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ত। মাছেদের সবচেয়ে বেশি আনাগোনা লেগে থাকত মুর্শিদাবাদের লালবাগ থেকে বেলডাঙা পর্যন্ত এবং নদিয়ার নবদ্বীপ থেকে শান্তিপুর পর্যন্ত এলাকায়। কিন্তু সেই দিন এখন স্মৃতি হয়ে গিয়েছে।’’
শান্তিপুরের গবরাচর এলাকা থেকে প্রতি দিন ১০ থেকে ১৫টি নৌকা যায় মাছ ধরতে। নবদ্বীপের ফাঁসিতলা ঘাট থেকে মাছ ধরতে যায় ১৫-১৬টা নৌকা। বহরমপুরের ভাগীরথী পার সংলগ্ন এলাকা থেকে ২০টিরও বেশি নৌকা নামে নদীতে। এক একটি নৌকায় থাকেন পাঁচ বা তার বেশি মৎস্যজীবী। জাল বিছিয়ে এবং সেই জাল তুলতে সময় লাগে কমপক্ষে ঘন্টাখানেক। এখন অধিকাংশ নৌকায় ফিরে আসছে খালি হাতে। ভাগীরথীর মৎস্য ভান্ডারের এমন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগে বিশেষজ্ঞরাও। মৎস্য বিশেষজ্ঞ তমোজ্যোতি অধিকারীর কথায়, ‘‘ভাগীরথীর মাছের ভান্ডার যে ভাবে বিলুপ্ত হচ্ছে তাতে আগামী দিনে কয়েকশো প্রজাতির মাছ ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাবে। অনেক কারণ থাকলেও মূলত প্রজননজনিত সমস্যা এর অন্যতম কারণ।’’
ভাগীরথীর মাছের ভাঁড়ার কমে আসা নিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার মৎস্য দফতরের সহ-অধিকর্তা রঞ্জন সামন্ত দায় ঠেলেছেন মৎস্যজীবীদের উপরেই। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘রাজ্য সরকারের উদ্যোগে প্রতি বছর গঙ্গায় মাছ ছাড়া হচ্ছে। কিন্তু মৎস্যজীবীরা নিজেরাই গঙ্গার মাছের ভান্ডার নষ্ট করছেন। সচেতন করার পরও মৎস্যজীবীরা ছোট মাছ এবং ডিম ভর্তি মাছ ধরছেন। মা মাছ ডিম ছাড়ার সুযোগ না পেলে মাছের যোগান বাড়বে কোথা থেকে?’’
মৎস্যজীবীদের আয় ক্রমশ কমে আসছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রতীক্ষাতেও আগের মতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত জালেই কি জড়িয়ে পড়তে হবে, ক্রমশ গভীর হচ্ছে আশঙ্কা।