ছবি: সংগৃহীত
মেঘলা আকাশ। স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া। ঠান্ডা পুবালি বাতাসের সঙ্গে কাঁপন ধরনো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি!
ইলিশ ধরার এমন আদর্শ আবহাওয়া অবশ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের পাতা ছাড়া এখন মেলা দুষ্কর। ফলে আষাঢ়ের শেষ সপ্তাহেও বাজারে তেমন ইলিশ নেই। অথচ এ বার অনেকেই ভেবেছিলেন লকডাউনে দূষণহীন নদী উপচে পড়বে জলের রুপোলি শস্যে। ভরা আষাঢ়ে এ সময়ে ইলিশে ইলিশে ছয়লাপ হয়ে যাবে দিঘা থেকে ডায়মন্ড হারবার। কিন্তু কোথায় কি? চারশো থেকে ছ’শো গ্রাম ওজনের ইলিশ সবে বাজারে আসতে শুরু করছে। তা-ও অনিয়মিত। দাম পাঁচশো থেকে সাতশোর মধ্যে। ফলে সে ইলিশের নাগালও সকলে পাচ্ছেন না।
কবে তবে পাতে পড়বে ইলিশ? আজ রোববারের পাতে কি তার দেখা মিলবে? করোনা সঙ্কট চলছে তো কী, আষাঢ়ের শেষ সপ্তাহে এসেও ইলিশের হদিস না পেয়ে অনেক গৃহবন্দি আত্মাই ছটফট করছে।
কলকাতার এক ইলিশ ব্যবসায়ী অশোক দাস জানাচ্ছেন, এ বার দিঘায় এখনও তত ইলিশ ওঠেনি। যা কিছু ইলিশ আসছে সবই ডায়মন্ড হারবার থেকে। কাকদ্বীপ, নামখানা, কুলতলি প্রভৃতি জায়গার ইলিশই আপাতত বাজারে মিলছে। এবং তা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। ফলে বাজারে সে ভাবে ইলিশের দেখা মিলছে না। তাঁর মতে, “জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহের আগে পর্যন্ত অন্য রকম কিছু হবে না। তার পর যদি কিছু পরিবর্তন হয়।”
যার নিটফল নদিয়া জেলায় তেহট্ট, করিমপুরের গ্রামীণ বাজার থেকে কৃষ্ণনগর, নবদ্বীপ বা রানাঘাটের শহুরে বাজারে ইলিশ বাড়ন্ত। সাড়ে চারশো থেকে পাঁচশো গ্রাম ওজনের ইলিশ বিকোচ্ছে ৫০০-৭০০ টাকা দরে। যে দিন জোগান তুলনায় একটু বেশি থাকে সে দিন দাম ৫০-১০০ টাকা কমে যায়। যে দিন ডায়মন্ড হারবারের মূল মোকাম থেকেই জেলার বাজারে কম মাছ ঢোকে সে দিন ওই মাছের দর লাফিয়ে সাড়ে ৬৫০-৭০০ টাকায় চড়ে। বাংলাদেশের পথভোলা ইলিশ সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কোনও ভাবে যদি বা বাজারে এসেই পড়ে তার দাম ১৪০০-১৮০০ টাকার নীচে নয়। অবশ্য সব বাজারে ওই দামের ইলিশ বিক্রি হয়ও না।
কিন্ত কেন এমন হাল ইলিশের?
কৃষ্ণনগরের মাছের পাইকার শতদল হালদারের কথায়, “ এ বার যা হাল দেশে ইলিশ আছে বলেই মনে হচ্ছে না! অথচ আমাদের হিসাব ছিল অন্য রকম। টানা তিন চার মাস মাছ ধরা হয়নি লকডাউনে। হিসাব মতো ইলিশ প্রমান সাইজে বেড়ে যাওয়ার কথা। আমরা সেই অঙ্ক কষে মাছের অর্ডার নিয়েছি। কিন্ত কোথায় মাছ! গড়ে সাড়ে চারশো গ্রাম ওজনের মাছ বাজারে আসছে। দাম ৭০০ টাকার আশপাশে। ওই দামে কে কিনবে ইলিশ?” তিনি জানান, রবিবারের বাজারের কথা মাথায় রেখে শনিবার দু’কুইন্টাল ইলিশ মজুত করেছিলেন। কিন্তু বিক্রি হবে কি না সন্দেহ। আবার অর্ডার নিয়ে প্রমাণ মাপের মাছ দিতে পারছেন না বলেও অশান্তি হচ্ছে।
করিমপুর বাজারের মৎস্য ব্যবসায়ী গোপাল হালদার বলেন, “শুধু কাকদ্বীপ বা নামখানা থেকেই ইলিশ আসছে। দিঘা বা বাঙলাদেশের ইলিশের কোনও খবর নেই। তবে সব দিন সমান নয়। গড়ে পাঁচশোর ওপরে মাছ নেই। দাম ৫০০-৭৫০ টাকা। কস্মিনকালে কেজিখানেক ওজনের ইলিশ এলে দাম ১২০০-১৬০০ টাকা পর্যন্ত উঠছে।”
ব্যারাকপুরের সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর প্রধান বিজ্ঞানী রঞ্জনকুমার মান্না বলেন, “ হিসাবে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। লকডাউনের জন্য তিন মাস মাছ ধরা হয়নি বা জলে নৌকা- ভেসেল চলেনি বলে ইলিশের প্রজনন পর্ব এ বার নির্বিঘ্ন হয়েছে, এটা অনেকটাই ঠিক। কিন্তু তা বলে প্রজননের সঙ্গে-সঙ্গে ইলিশ বড় হয়ে নদী ভরে যাবে, এই ভাবনাটা ঠিক নয়। এমনিতেই ইলিশের বৃদ্ধি খুব ধীর গতিতে হয়। এ বার ইলিশের ভাল প্রজননের ফল মিলতে পারে আগামী শীতে। এখনই নয়।”
কলকাতার পাইকার অশোক বিশ্বাস জানাচ্ছেন, এখন যে মাছ প্রতি দিন উঠছে তার বেশির ভাগটাই বাছাই হয়ে চলে যাচ্ছে স্টোরে। কেননা মরসুমের গোড়ায় ইলিশ মজুত করাই নিয়ম। ফলে যা ধরা হচ্ছে, তার ২০-২৫ শতাংশ মাছ বাজারে আসছে এখন। এই ঘাটতি সে কারণেও। মজুত করা শেষ হলে বাজারে দৈনিক জোগান বেড়ে যাবে। দামও কিছুটা কমবে। রানাঘাটের মাছ বিক্রেতা পবিত্র সরকারও বলেন, “যেটুকু ইলিশ উঠছে তার বেশির ভাগটাই মজুতদারেরা স্টোরে রেখে দিচ্ছেন। তারপর রোজকার বাজারের সরবরাহ হচ্ছে। ফলে জোগানে ঘাটতি থেকে দাম চড়ছে। সাড়ে চারশো গ্রামেরও কম ওজনের মাছ ৫০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।”
নবদ্বীপের আগমেশ্বরী বাজারের মাছ ব্যবসায়ী বাদল হালদারের মতে, “শ্রাবণের আট-দশ তারিখের আগে ইলিশের হাল এমনই থাকবে। তার পর একটা জো আসার সম্ভবনা আছে। সেই দিকে সকলে তাকিয়ে রয়েছে। তবে এ বার বাংলাদেশের ইলিশের আশা ছেড়ে দেওয়াই ভাল। শুনেছি, করোনার কারণে ইলিশ আমদানি বন্ধ। ছুটির দিনেও বাজারে পাঁচশো গ্রামের বেশি ওজনের মাছ মিলবে না। ৭০০ টাকা কেজিতে সে মাছ খাওয়ার লোক কোথায়?” সার কথা হল, আপাতত স্থানীয় বাজারে সস্তায় ইলিশ খাওয়া আশা না করতেই বলছেন মৎস্য ব্যবসায়ীরা। ইলিশেও আপাতত লকডাউন!