প্রতীকী ছবি।
রাজ্যে যে দু’টি শহরে জগদ্ধাত্রী পুজোই সবচেয়ে বড় উৎসব, তার অন্যতম চন্দননগর চার দিনের পুজো এবং বিসর্জনে সুরক্ষা বিধি মানতে বদ্ধপরিকর। সেখানকার ঐতিহ্যবাহী বিসর্জনের শোভাযাত্রা এ বার হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে শহরের কেন্দ্রীয় জগদ্ধাত্রী পুজো কমিটি। অথচ কৃষ্ণনগরের বেশ কিছু বারোয়ারি হাইকোর্টের নির্দেশ অগ্রাহ্য করতেই আগ্রহী। এবং এর জন্য রাজনৈতিক নেতাদের একাংশকে দায়ী করছেন বহু কৃষ্ণনাগরিক।
রাজনৈতিক মিটিং-মিছিলের সময়ে বিভিন্ন দলের নেতাদের যে বেপরোয়া অসাবধানতা দেখা গিয়েছে, কৃষ্ণনগরে সাং নিয়ে জলঘোলার সময়েও তাঁদের বেশির ভাগের ভূমিকা আদৌ সদর্থক নয় বলে অভিযোগ নাগরিকদেরই একাংশের। বিভিন্ন পুজো কমিটির সঙ্গে যুক্ত শাসক দলের নেতাদের একাংশ থেকে শুরু করে ভোটারের মন পেতে ব্যাকুল বিরোধী নেতাদের নীরবতা অথবা প্রচ্ছন্ন মদত তা-ই প্রমাণ করছে বলে তাঁরা মনে করছেন।
দিল্লি, গুজরাত-সহ বেশ কিছু জায়গায় করোন সংক্রমণের হার ফের ঊর্ধ্বমুখী। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদীর সরকার লম্বা লকডাউন থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত নানা কঠিন পদক্ষেপ করলেও কৃষ্ণনগরে তাঁর দলের ভূমিকা লক্ষণীয়। হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে বিসর্জনের শোভাযাত্রা বন্ধ রাখার সপক্ষে জনমত গড়ার চেষ্টা বিন্দুমাত্র বিজেপির তরফে চোখে পড়ছে না। উল্টে আসন্ন বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে তৃণমূলকে লেজে-গোবরে করার জন্য গেরুয়া বাহিনীর নেতাদের একাংশ সাঙের দাবি উসকে দিচ্ছেন, এমন অভিযোগ রয়েছে শাসক দলের।
কৃষ্ণনগরের অন্যতম পুরপ্রশাসক, তৃণমূল নেতা অসীম সাহার অভিযোগ, “এই অতিমারির আবহে শুধু সাং কেন, সমস্ত ধরনের ভিড় এড়িয়ে চলাই প্রয়োজন। কিন্তু বিজেপি সেখানে মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে সাং নিয়ে সংকীর্ণ রাজনীতি করছে।” বিজেপির নদিয়া উত্তর সাংগঠনিক জেলা কমিটির মিডিয়া কনভেনর সন্দীপ মজুমদার পাল্টা বলেন, “কে কী বলছেন, জানি না। আমরা কিন্তু প্রথম থেকেই বলে আসছি যে মানুষের আবেগকে গুরুত্ব দিয়েও আলোচনার মাধ্যমে হাইকোর্টের রায়কে বাস্তবায়িত করতে হবে। প্রশাসন সেটা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তৃণমূল নেতাদের দু’মুখো অবস্থান পরিস্থিতেকে আরও জটিল করে তুলছে। এখনও সময় আছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার।”
বস্তুত শাসক দল তৃণমূল পড়েছে শাঁখের করাতে। এক দিকে প্রশাসনের অংশ হিসেবে আদালতের নির্দেশ মেনে চলার বাধ্যবাধকতা, অন্য দিকে সাং নিয়ে ‘আবেগ’ নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়। শোভাযাত্রা বা জনসমাবেশ নিয়ে এই নিষেধাজ্ঞা যে নাগরিকদেরই কল্যাণের কারণে তা বুঝিয়ে উঠতে পারার ক্ষমতা এঁরা অনেকেই কার্যত হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু যে মৌলিক প্রশ্নের সদুত্তর নেতারা দিতে পারছেন না, তা হল রাজনৈতিক সভাসমিতি ও জমায়েতে শয়ে-শয়ে মানুষ ভিড় জমিয়েছেন দূরত্ববিধি লঙ্ঘন করে, অনেকে মুখে সামান্য মাস্ক পর্যন্ত ছিল না, সে ক্ষেত্রে কোন যুক্তিতে সাঙের বিরোধিতা করা হচ্ছে? সাম্প্রতিক কালে এক মাত্র সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্রের সভা বাদে আর প্রায় সব রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সুরক্ষা বিধি ব্যাপক ভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ। পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের বক্তব্য, সে সব ক্ষেত্রে আদালতের কোনও নিষেধাজ্ঞা না থাকায় তাঁরা কিছু করে উঠতে পারেননি। কিন্তু নেতারা এখন কী যুক্তি দেবেন? একটি ভুল যে আর একটি ভুলের যুক্তি হতে পারে না, সে কথা বলারও মুখ নেই তাঁদের।
কাঁঠালপোতা বারোয়ারির সভাপতি তথা জেলা তৃণমূলের মুখপাত্র দেবাশিস রায় অবশ্য দাবি করছেন, “আমাদের দলের কর্মসূচিতে প্রত্যেকটি বিধি মেনে চলা হয়েছে। আইন বা আদালতের নির্দেশ প্রত্যেকে মানতে বাধ্য।” বিজেপির সন্দীপেরও দাবি, “রাজ্য জুড়ে সবাই মিটিং-মিছিল করছে, তাই আমরাও করছি। সব বিধি মেনেই করছি।”
তবে রবিবার রবীন্দ্র ভবনে বারোয়ারিগুলির প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রশাসনের বৈঠকে একপ্রস্ত উত্তেজনা তৈরি হওয়ার পর পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে শুরু করেছে। সাং বার না করার পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নিতে শুরু করেছেন কৃষ্ণনগরের প্রধান সারির তৃণমুল নেতারা। তৃণমবল বিধায়ক গৌরীশঙ্কর দত্তের পাড়ার গোলাপট্টি বারোয়ারি আগেই সাং বার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরে কাঁঠালপোতা বারোয়ারি বা প্রাক্তন তৃণমূল কাউন্সিলর দিলীপ দাসের রায়পাড়া মালিপাড়ার মতো বড় বারোয়ারিগুলি সাং বার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আবার চাষাপাড়া, চকেরপাড়া, বাঘাডাঙার মতো বারোয়ারিগুলি নিজেদের অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসে নিজেদের মধ্য আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছে।