(বাঁ দিক থেকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কুণাল ঘোষ, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
তৃণমূলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠিক নীচের স্তরে দলীয় নেতৃত্বের ভরকেন্দ্র কে, তা নিয়ে ‘দ্বন্দ্ব’ প্রকাশ্যে এসে পড়ছে। সেই আবহেই শনিবার তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসির প্রতিষ্ঠা দিবসে শিয়ালদহের জনসভায় তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করলেন প্রবীণ সাংসদ তথা লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রকাশ্য সভায় তিনি জানিয়ে দেন, মমতা-অভিষেক ইস্যুতে কুণাল ঘোষের বাক্যবন্ধই দলের লাইন হওয়া উচিত।
ওই কর্মসূচিতে রাজ্যের মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, আইএনটিটিইউসির রাজ্য সভাপতি ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন কুণালও। বক্তৃতায় সুদীপ বলেন, ‘‘মমতা-অভিষেক ইস্যুতে আমি একটা লাইন পেয়ে গিয়েছি। আমি দেখি কুণাল এটা সব জায়গায় বলে। সংবাদমাধ্যমেও বলে। কুণাল বলে— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেনাপতিত্বে তৃণমূল চলছে। আমিও এটাই বলব, আপনারাও বলবেন।’’ এই বক্তৃতায় মমতার পাশাপাশি অভিষেকের নেতৃত্বেরও প্রশংসা করেন সুদীপ।
বেশ কিছু দিন রাজনৈতিক নেতৃত্বের বয়স, নতুন-পুরনো তৃণমূল, মমতা-অভিষেক দ্বন্দ্বের মতো বিষয় তৃণমূলের অভ্যন্তরেও আলোচ্য হয়ে উঠেছে। দলে অভিষেকের উত্থানের আগে থেকে যাঁরা মমতার সঙ্গে থেকে তৃণমূলের মাথায় ছিলেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গেই বর্তমানে অভিষেকের ঘনিষ্ঠ মহলের ‘দ্বন্দ্ব’ও অন্যতম আলোচ্য। এই দ্বন্দ্ব কখনও কখনও প্রকাশ্যেও এসেছে। কখনও আবার বদলে গিয়েছে ‘সুর’। অভিষেকের নেতৃত্ব নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলা সাংসদও পরবর্তী কালে তাঁকে মেনে নিয়েছেন প্রকাশ্যেই।
অতি সম্প্রতি এই দ্বন্দ্বচর্চা নতুন করে শুরু হয় নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে তৃণমূলের বিশেষ অধিবেশনের সময়। সেখানে সশরীরে যাননি অভিষেক। চোখের সমস্যার কারণে তিনি খানিক ক্ষণের জন্য যোগ দিয়েছিলেন ভার্চুয়ালি। সেই মঞ্চে অভিষেকের ছবি না-থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন কুণাল। একটি সাক্ষাৎকারে কুণাল বলেন, ‘‘অভিষেকের ছবি না থাকায় তৃণমূলের মঞ্চ অসম্পূর্ণ লাগছিল।’’ তা ছাড়া তৃণমূলের প্রবীণ নেতাদের নিয়েও কুণালের মন্তব্য দলের মধ্যে ঝড় তুলে দিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘‘কেউ যদি ভাবেন দেহত্যাগ না করলে পদত্যাগ করবেন না, তা হলে দলটা ক্রমশ সিপিএমের বৃদ্ধতন্ত্রের দিকে যাবে।’’ কুণালের ওই কথার পাল্টা বলেন দমদমের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায়। তিনি মমতার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘‘বয়স আবার কী! মমতাই তো বলেছেন, মনের বয়সটাই আসল।’’ এর মধ্যে রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকেও পড়তে হয় বয়স সংক্রান্ত প্রশ্নের মুখে। ফিরহাদ চটজলদি জানান, তিনি নবীন বা প্রবীণ কোনওটাই নন। তিনি ‘মধ্যবয়স্ক’। একই সঙ্গে তাঁর মত, মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা থাকলে তাঁকে ভোটে টিকিট দেওয়াই উচিত।
তবে উত্তরবঙ্গ সফরে রওনা হওয়ার আগে গত সোমবার অভিষেক তাঁর ‘ভারসাম্যের বয়সনীতি’ স্পষ্ট করেছিলেন। তৃণমূলের ‘সেনাপতি’ বলেছিলেন, ‘‘আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, সমস্ত পেশাতেই অবসরের বয়ঃসীমা আছে। বয়সের ঊর্ধ্বসীমাও আছে। শুধু রাজনীতি কেন, ক্রিকেট, ফুটবল— সবেতেই অবসরের বয়স আছে।’’ একই সঙ্গে তিনি এ-ও বলেন, ‘‘যদি কেউ মনে করেন, যাদের বয়স ২০, ২৫ বা ৩০— তারাই শুধু তৃণমূল করবে, তা হলে মনে রাখতে হবে, বিষয়টা সেটাও নয়।’’
শনিবার আইএনটিটিইউসির সভাও এড়াতে পারেনি মমতা-অভিষেক দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গ। সেখানেই সুদীপের মন্তব্য তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকে। সুদীপের পাশাপাশি শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ও মমতার পাশাপাশি অভিষেকের নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। অনেকের মতে, কুণাল যে কথা বলেন, তাতে স্পষ্ট যে তিনি মমতা-অভিষেক যুগলবন্দির কথা বলতে চান। আবার তৃণমূলের একাংশের নেতা বার বার বলেন, মমতাই সব। তিনিই শেষ কথা। সুদীপ শনিবার বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি কুণাল মডেলই অনুসরণ করবেন। অন্তত প্রকাশ্যে।