শুভেন্দু অধিকারীর ইস্তফার পর দ্রুত ওই পদে নিযুক্ত হয়েছেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশনার্সের (এইচআরবিসি) চেয়ারম্যান পদে ইস্তফা দিলেন রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। বৃহস্পতিবার ওই ইস্তফার পর তাঁর মন্ত্রিত্ব এবং দলত্যাগের জল্পনা আরও তীব্র হয়েছে। শুভেন্দুর ইস্তফার পর দ্রুত ওই পদে নিযুক্ত হয়েছেন তৃণমূলের প্রথম সারির সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ হল, ঔপচারিকতা মেনে কল্যাণের ওই নিয়োগপত্রে সাক্ষর করতে হয়েছে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কে। যাঁকে বৃহস্পতিবারই কড়া আইনি আক্রমণ করেছেন কল্যাণ। ফৌজদারি মামলার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন।
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, কল্যাণ আগেও একাধিক বার এইচআরবিসি-র চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। ফলে সে ভাবে দেখলে তাঁর নিয়োগ ‘রুটিন’ বলেও বর্ণনা করা যেতে পারে। কিন্তু অতি সম্প্রতি শুভেন্দু এবং কল্যাণের যে পারস্পরিক বাক্য বিনিময় হয়েছে, তাতে শুভেন্দুর পদত্যাগের পর রাজ্য সরকারের সুপারিশে ওই পদে কল্যাণকে নিয়োগও নিশ্চিত ভাবে ‘রাজনৈতিক বার্তা’ বহন করছে।
সরকারি ওই পদ থেকে শুভেন্দুর ইস্তফার পর তৃণমূলের একাধিক প্রথমসারির নেতা জানিয়েছেন, তাঁরা মনে করছেন, এই ইস্তফা শুভেন্দুর দলত্যাগের প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ। এর পর শুভেন্দু মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দেবেন। অতঃপর তাঁর দলত্যাগ স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। দলীয় সংগঠনের শীর্ষ স্তরে জড়িত এক নেতার কথায়, ‘‘আমরা শুনেছি, এইচআরবিসি-র চেয়ারম্যানের পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর শুভেন্দু হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের শীর্ষপদেও ইস্তফা দেবে। তার পর মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রকাশ্যে ঘোষণা করবে।’’ সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের জরুরি বৈঠক হয়েছে। সেখানে চেয়ারম্যান-সহ বিবিধ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু শুভেন্দু পর্ষদের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দিয়েছেন, রাত পর্যন্ত এমন খবরের সমর্থন মেলেনি।
আরও পড়ুন: সমস্ত পরিবার স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের আওতায়, বিরাট ঘোষণা মমতার
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবারের ইস্তফা প্রসঙ্গে শুভেন্দুর কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তাঁকে ফোন করা হলেও রাত পর্যন্ত কোনও প্রত্যুত্তর মেলেনি। প্রসঙ্গত, শুভেন্দুর সঙ্গে দলের দূরত্ব বৃদ্ধির পর তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায়। তবে তাঁর সঙ্গে শুভেন্দুর দু’দফা আলোচনার পরেও সমস্যার সমাধান হয়নি। যদিও দ্বিতীয়বার আলোচনার পর সৌগত বলেছিলেন, ‘‘আমি আশাবাদী। আবার আলোচনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছি না।’’ তবে ওই প্রক্রিয়া চলাকালীন দলের অন্দরে শুভেন্দুকে নিয়ে স্পষ্টতই একটা বিভাজন লক্ষ্য করা গিয়েছে। একান্ত আলোচনায় নেতাদের একটি অংশ জানিয়েছেন, তাঁরা মনে করেন বিধানসভা ভোটের আগে শুভেন্দু দল ছাড়লে দলের ভাল হবে না। আবার অন্য একাংশ বলেছেন, সংগঠন নিয়ে শুভেন্দু যে দাবি করছেন, তা মেটানো এখন সম্ভব নয়। শুভেন্দুকে দলে থাকতে গেলে দলের অনুশাসন মেনেই থাকতে হবে। ফলে বিষয়টি ঝুলেই ছিল।
এর মধ্যেই গত মঙ্গলবার শুভেন্দু-প্রশ্নে মধ্য কলকাতায় এক বৈঠকে বসেছিলেন তৃণমূলের তিন প্রথমসারির সাংসদ। সূত্রের খবর, সেখানে তাঁরা এ বিষয়ে একমত হন যে, শুভেন্দু দল ছাড়লে নির্বাচনের আগে দল লাভবান হবে না। একটা সময়ে ওই আলোচনায় যোগ দেন ভোট-কৌশলী প্রশান্ত কিশোরও। ঠিক হয়, পরে আবার তাঁরা নিজেদের আলোচনায় বসবেন। সেই আলোচনার পরেই সৌগত আবার শুভেন্দুর সঙ্গে তৃতীয় বার কথা বলবেন। ঘটনাচক্রে, সোমবারেই শুভেন্দুর সঙ্গে দ্বিতীয়দফার আলোচনায় বসেছিলেন সৌগত। সেই আলোচনায় কী হয়েছে, তা নিয়েও মঙ্গলবারের বৈঠকে আলোচনা হয়। প্রসঙ্গত, সৌগতর সঙ্গে প্রথমদফার আলোচনায় শুভেন্দু সরাসরিই বলেছিলেন, তিনি দলের অন্দরে কাজের ‘স্বাধীনতা’ চান। যার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে তিনি যে ৬টি জেলার পর্যবেক্ষক ছিলেন, সেগুলি তাঁকে ফিরিয়ে দিতে হবে। সৌগত নিজে ওই বিষয়ে মুখে কুলুপ আঁটলেও অসমর্থিত সূত্রের খবর, দলনেত্রীকে তিনি যে মৌখিক রিপোর্ট দিয়েছিলেন, তাতে বলা হয়েছিল, শুভেন্দু মূলত চারটি সমস্যার কথা বলেছেন। তার দু’টি দলের তরুণ সাংসদ অভিযেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ভোট-কৌশলী প্রশান্ত কিশোর সংক্রান্ত। অন্যটি দলের অন্দরে ‘পর্যবেক্ষক’ তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত। নেত্রী মমতা তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলুন, শুভেন্দু এমনও দাবি করেছিলেন বলে খবর। দ্বিতীয় দফার বৈঠকে শুভেন্দু আবার দলের বেশ কয়েকজন নেতাকে ভোটের টিকিট দেওয়ার কথা বলেছিলেন।
যে তিন সাংসদ শুভেন্দুকে নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন আবার পরদিনই দিল্লি চলে যান। তাঁর ফেরার কথা ১ ডিসেম্বর। ফলে ধরে নেওয়া হচ্ছিল, ১ তারিখের আগে আর কিছু হবে না। তার মধ্যেই শুভেন্দুর এই ইস্তফা। যদিও দলের সঙ্গে আলোচনার কোনও বিষয়েই শুভেন্দুর তরফে কোনও আনুষ্ঠানিক সমর্থন পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি তাঁর প্রতিক্রিয়াও। কিন্তু পর্যবেক্ষক পদ যে শুভেন্দুকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না, সে বিষয়ে দলীয় নেতৃত্ব একমত ছিলেন। যদিও আশাবাদীদের মধ্যে অনেকে বলেছিলেন, শুভেন্দুর প্রয়োজনীয়তা বুঝলে দল ওই বিষয়ে অবস্থান বদলাতেও পারে।
তার মধ্যেই তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাঁকুড়া সফরে যান। এবং তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যান কল্যাণকে। সেই বিষয়টি খুব ভাল ভাবে নেয়নি শুভেন্দু শিবির। ওই সফর চলাকালীন তাঁর অনুগামীদের একাংশ বলেন, ‘‘যিনি দাদাকে লক্ষ্য করে এত কথা প্রকাশ্যে বলেছেন, দিদি তাঁকে নিয়েই মঞ্চে উঠলেন! এর থেকে আমরা কী বার্তা পাব?’’ ঘটনাচক্রে, বুধবার বাঁকুড়ার সভা থেকে মমতা ঘোষণা করেন, বাংলার সর্বত্র তিনিই দলের ‘পর্যবেক্ষক’। তিনি আরও বলেন, রাতের অন্ধকারে কে বা কারা বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, তিনি সমস্ত খবর রাখেন। দলনেত্রীর সেই ‘সঙ্কেত’ও শুভেন্দু শিবিরের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল। তার পরেই বৃহস্পতিবার শুভেন্দুর ইস্তফার ঘটনা।
আরও পড়ুন: বঙ্গে ভোটের পালে ‘হিন্দুত্ব হাওয়া’ টানতে অভিযান করবে হিন্দু পরিষদ
প্রসঙ্গত, এইচআরবিসি-র নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান কল্যাণ প্রথম ওই পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন ২০১১ সালের অগস্ট-সেপ্টেম্বরে। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে দাঁড়ানোর সময় তিনি ওই পদ ছেড়ে দেন। ভোটে জিতে আবার তিনি ওই পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। আবার ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের আগে কল্যাণ ওই পদ ছাড়েন। তবে ভোটে জেতার পর তাঁকে আর ওই পদে নিয়োগ করার সুপারিশ করেনি রাজ্য সরকার। ওই পদে বসানো হয় প্রাক্তন সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদীকে। কিন্তু দেড়মাসের মধ্যে দীনেশ ওই পদ ছেড়ে দেন। তার কারণ হিসেবে বিবিধ ব্যাখ্যা শোনা যায় প্রশাসনিক মহলে। দীনেশের পর ওই পদে ছিলেন পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু। বৃহস্পতিবার তিনি ওই সরকারি পদে ইস্তফা দেওয়ার পর আবার কল্যাণকেই সেখানে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
এখন দেখার, তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্বের একাংশের অনুমান সত্যি করে শুভেন্দু অতঃপর মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দেন কি না। তেমন হলে তাঁর তৃণমূল ত্যাগও স্রেফ সময়ের অপেক্ষা হয়ে রয়ে যাবে।