মূল ফটক বন্ধ রাজবাড়ির। বাইরেই ছবি তোলা। নিজস্ব চিত্র।
বাঁকুড়ার বড়জোড়া থেকে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি বেড়াতে এসেছিলেন মনোজিৎ ফৌজদার। অনেক আকুতি-মিনতি করেও ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির ভিতরে ঢুকতে পারেননি। কলকাতার টালিগঞ্জের বাসিন্দা এক যুবক সপরিবারে ঝাড়গ্রাম বেড়াতে এসে উঠেছিলেন রাজবাড়ি সংলগ্ন পর্যটন উন্নয়ন নিগমের টুরিস্ট কমপ্লেক্সে। তাঁরাও রাজবাড়ি ঢুকতে পারেননি। পর্যটনের ভরা মরসুমে গত ডিসেম্বর মাস থেকে একাধিক কারণে রাজবাড়ির মূল ফটক বন্ধ। তৈরি হচ্ছে ক্ষোভ। রাজ পরিবারের সদস্যরা চাইছেন, প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সুষ্ঠভাবে নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে পর্যটকরা রাজবাড়ি দেখুন। এর জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি চালু হোক। রাজবাড়ি চত্বর নোংরা হলে তা পরিষ্কারের দায়িত্বও পুরসভা নিক।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে রাজপুতানার সর্বেশ্বর সিংহ চৌহান ঝাড়গ্রামের জংলি মাল রাজাকে পরাস্ত করে মল্লদেব রাজ বংশের সূচনা করেন। পরবর্তী কালে ১৮ জন রাজা গড় ঝাড়গ্রামের শাসক ছিলেন। মল্লদেব রাজ বংশের শেষ রাজা নরসিংহ মল্লদেবের আমলে ১৯৩০ সালে মুসলিম গথিক শৈলিতে তৈরি হয় নতুন রাজপ্রাসাদ। নরসিংহ পুরনো রাজবাড়ির দোতলায় দক্ষিণের একটি ঘরেই থাকতেন। নতুন রাজপ্রাসাদের পিছনে লোকচক্ষুর অগোচরে রয়েছে কয়েকশো বছরের পুরনো খিলান দেওয়া চুনসুরকির দোতলা রাজবাড়িটি। লর্ড ওয়েলিংটন, প্রফুল্ল ঘোষ, বিধান রায় এই রাজবাড়িতে এসেছিলেন। থেকেছেন উত্তম কুমারও। বেশ কিছু সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে এখানে।
রাজবাড়ি ব্যক্তিগত সম্পত্তি হলেও এর অতিথিশালা রয়েছে। সেখানে ১৪টি ঘরে মোট ৪০ জন পর্যটক থাকতে পারেন। নতুন করে আরও ৮টি ঘর সংস্কার করে পর্যটকদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে রাজ পরিবার সূত্রে খবর। এখন যে সব পর্যটক রাজবাড়ির অতিথিশালায় থাকেন, কেবলমাত্র তাঁরাই এখন ভিতরে ঘুরতে পারেন। আর কেউ নয়। যদিও আগে এমনটা ছিল না। একসময় ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির দ্বার দর্শক থেকে পর্যটকদের জন্য অবাধ ছিল।
রাজবাড়ির দরজা সাধারণের জন্য বন্ধ হল কবে, কীভাবে?
জানা গিয়েছে, ২০১৭ সালে মদ্যপ অবস্থায় কয়েক জন যুবক এসে রাজবাড়ির দোতলায় উঠে গণ্ডগোল করেছিলেন। তারপর থেকেই এর দ্বিতীয় দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারপর সেখানে সিভিক ভলান্টিয়ার মোতায়ন থাকত। তবে পর্যটকরা মূল ফটক অর্থাৎ সিংহদুয়ার পেরিয়ে রাজবাড়ি চত্বরে ঢুকতে পারতেন। ২০২১ সালে রাজবাড়ি চত্বর থেকে চন্দন গাছ চুরি হয়ে যায়। তারপর রাজবাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়। তারপরে ভিতরে ঢোকায় আরও কড়াকড়ি হয়। তবে রাজবাড়ি সংলগ্ন পর্যটন উন্নয়ন নিগমের টুরিস্ট কমপ্লেক্সে যাঁরা থাকতেন তাঁরা টিকিটের ভিত্তিতে রাজবাড়ি চত্বরে বেড়াতে পারতেন। এরপরে গত বছর পুজোর সময়ে ড্রোন উড়িয়ে রাজবাড়ির ব্যক্তিগত জায়গার ছবি তোলার অভিযোগ ওঠে। ঝাড়গ্রাম রাজ পরিবারের দাবি, মানুষজন রাজবাড়ি চত্বরে ঢুকে নোংরা করছেন। অনেকে রাজবাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে পড়ছে। কেউ কেউ মদ্যপ অবস্থায় ঢুকছেন। এইসব কারণেই গত ডিসেম্বর মাস থেকে রাজবাড়ির মূল ফটক বন্ধ। বিশেষ অনুমতি ছাড়া ঢোকা নিষেধ।
রাজবাড়ির অতিথিশালার কর্ণধার নরসিংহের প্রপৌত্র তথা দুর্গেশ মল্লদেবের ছেলে বিক্রমাদিত্য মল্লদেব বলেন, ‘‘পুরনো ঐতিহ্য বজায় রেখে রাজবাড়ির ভিতরে এখনও মোরামের রাস্তা রয়েছে। মূল দরজা খোলা থাকলে প্রচুর গাড়ি ভেতরে ঢুকে যায়। চারপাশ নোংরা হয়।’’ সমস্যার কথা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে বলেও জানান তিনি। তিনি জুড়েছেন, ‘‘রাজবাড়ি প্লাস্টিক ফ্রি জ়োন হিসেবে ঘোষণা খুবই প্রয়োজন। পর্যটকরা রাজবাড়ি দেখুন। আমাদের সমস্যা নেই। কিন্তু নোংরা ও যান নিয়ন্ত্রণ কে রুখবে!’’ জেলাশাসক সুনীল আগরওয়াল বলেন, ‘‘রাজবাড়ি হচ্ছে ওঁনাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তবে এটাও ঠিক, রাজবাড়ির দেখতে অনেক পর্যটক আসেন। রাজপরিবারের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করছি।’’