দাসপুর ব্লকে চলছে সমীক্ষা। ফাইল চিত্র।
চলছিল দলের সাংগঠনিক বৈঠক। সেখানেই এক কর্মী তাঁর বুথে আবাস প্লাসের তালিকা নিয়ে কথা শুরু করেছিলেন। কথা শেষ হওয়ার আগেই ওই কর্মীকে ধমক দিয়ে বিধায়ক তথা জেলাপরিষদের সভাধিপতি উত্তরা সিংহ জানিয়েছিলেন, আবাসের বিষয়টা পুরোটা প্রশাসন দেখছে। দলের কারও নাক গলানোর দরকার নেই। বৈঠক জুড়ে নিস্তব্ধতা। কর্মীরা আর কথা বাড়াননি। এই ছবি গড়বেতার। যেখানে আবাস প্লাসের তালিকায় থাকা নিজের ভাইয়ের নাম কাটতে স্বতঃপ্রণোদিত উদ্যোগী হয়েছিলেন তৃণমূলের ব্লক সভাপতি স্বয়ং। আবাস প্লাসের বাড়ি নিয়ে হইচইয়ের মধ্যে গড়বেতার এই ঘটনা দৃষ্টান্তমূলক।
দুয়ারে পঞ্চায়েত ভোট। গ্রামের ভোট। সেই ভোটের আগে ‘আবাস’ বিড়ম্বনায় ফেলুক, চায় না শাসকদল তৃণমূল। সতর্ক প্রশাসন। আবাসের তথ্য যাচাইয়ে কড়া নজর পুলিশ ও প্রশাসনের আধিকারিকদের। দলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এখন নিয়ম করে বলছেন, ‘‘এ বারের পঞ্চায়েত ভোট নির্বিঘ্নেই হবে।’’ বিঘ্ন ছাড়াই পঞ্চায়েত ভোট করতে মরিয়া শাসক কোনওমতেই চাইছে না আবাস যোজনার মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে জটিলতা বাড়ুক বা বিতর্ক বাড়িয়ে বিরোধীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রামের আবেগকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করুক। নিয়োগ দুর্নীতিতে জর্জরিত ঘাসফুল শিবির তাই আবাসে রক্ষণাত্মক। তৃণমূলের জেলা কো অর্ডিনেটর অজিত মাইতি বলছেন, ‘‘দলে মিটিং করে কঠোরভাবে বলে দিয়েছি সরকার যেভাবে আবাস প্লাসে তথ্য যাচাই করছে করুক, সেখানে দলের কেউ যাতে যুক্ত না হয়। এমনকি আমার নামটা তুলে দিন - এই কথাটাও যেন কেউ না বলেন। যদিও এখনও পর্যন্ত এরকম অভিযোগ আসেনি।’’ নির্ধারিত সময়ে ভোট হলে তা হওয়ার কথা আগামী বছরের মে মাসে। ভোট কিছুটা এগিয়ে আসতে পারে বলেও জল্পনা রয়েছে। চূড়ান্ত তালিকা ধরে বাড়ি বরাদ্দ তার আগে আগেই হতে পারে। তাই বাড়তি সতর্ক থাকতে চাইছে শাসকদল।
এক আশাকর্মী বলছিলেন, তাঁদের না কি উপর থেকে বলে দেওয়া হয়েছে আবাসের তথ্য যাচাইয়ের সময় তাঁরা যেন কোনও নেতা বা কর্মীকে নিয়ে না ঘোরেন। কেন? এক সরকারি আধিকারিকের উত্তর, ‘‘উপর থেকে কড়া নির্দেশ আছে আবাস যোজনার তালিকাভুক্ত উপভোক্তাদের বাড়ির অবস্থা কেমন তা যাচাই করতে আশা, আইসিডিএস, প্রাণিবন্ধু, প্রাণিমিত্ররাই যাবেন। অন্য কেউ নন।’’ ব্যাখ্যা দিয়ে ওই আধিকারিক বলছিলেন, আসলে আবাস যোজনা নিয়ে অভিযোগের তো শেষ নেই! সেখানে আরও জল মিশুক চাইছে না সরকার। তাই সংশ্লিষ্ট গ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকা কর্মীদেরই এ কাজ করতে বলা হয়েছে নিরপেক্ষভাবে। সেটা করতে গিয়েই চোখরাঙানি, হুমকির মধ্যে পড়তে হচ্ছে বলে জানাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ আশাকর্মী ইউনিয়ন ও পশ্চিমবঙ্গ অঙ্গনওয়াড়ি ওয়ার্কার্স ও হেল্পার্স ইউনিয়ন।
পঞ্চায়েত ভোটের আগে আশাকর্মী, প্রাণিবন্ধুদের এই ক্ষোভেই ইন্ধন দিচ্ছে বাম দল এসইউসি। রাজ্যে পট পরিবর্তনে যারা কিছুটা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল। আশা ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের শাখা সংগঠনকে মজবুত করে নিতে চাইছে এসইউসি। তাদের শ্রমিক সংগঠন এআইউটিইউসি-র জেলা সম্পাদক পূর্ণ বেরা বলেন, ‘‘জেলার বিভিন্ন জায়গায় আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে প্রশাসন। আমরা তার প্রতিবাদ করছি।’’ আবাসের তথ্য যাচাইয়ের কাজে নামা আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করছে অন্যান্য বিরোধী দলগুলিও। এখানেই সাবধানী শাসক শিবির। আবাস প্লাসের যে তালিকা নিয়ে হইচই বাড়ছে, সেই তালিকা দলের কেউ করেনি বলে তৃণমূল এখন থেকেই দায় ঝেড়ে ফেলছে। দলের নেতা অজিত মাইতি বলছেন, ‘‘তালিকা তো সরকারি কর্মীরা করেছে, দলের তো কেউ করেনি। সেখানে কিছু ভুলভ্রান্তি হয়েছে।’’ সেই তালিকায় পাকা বাড়ির মালিক তৃণমূল নেতাদের নাম উঠল কী করে? তৃণমূলের আর এক নেতা মানছেন, ‘‘এখন দলের অনেকেই নাম বাতিল করে দিচ্ছেন।’’ আর যাঁরা নাম বাতিল করছেন না? ঘাটালের এক আশাকর্মী বলছেন, ‘‘তৃণমূলের বুথ, অঞ্চল স্তরের নেতারা সরাসরি হুমকি দিচ্ছে, চাকরি নট হয়ে যাবে বলছে।’’
পাঁচ বছর আগের পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধীদের মনোনয়নে বাধা, বা নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপনে বলপ্রয়োগ যেমন ঘাসফুল শিবিরের কাছে কাঁটা হয়ে বিঁধছে এখনও, এবার আবাসেও সেরকম হলে হিতে বিপরীত হতে পারে, সেটা আঁচ করেই বাড়তি সতর্ক শাসক শিবির। যদিও বিরোধীরা এখন থেকেই আবাস প্লাস নিয়ে খোঁচা দিতে শুরু করেছে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুশান্ত ঘোষ বলছেন, ‘‘স্বজনপোষণ আর দুর্নীতি— এটাই তৃণমূলের কাজ। আবাস যোজনার কাজেও তৃণমূলের দুর্নীতি আর গোপন নেই।’’ বিজেপির জেলা সম্পাদক গৌতম কৌড়ির কটাক্ষ, ‘‘আবাস যোজনা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প, সেখানেও হস্তক্ষেপ করছে তৃণমূল। পঞ্চায়েত ভোটে আবাস কেলেঙ্কারিই তৃণমূলের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেবে।’’ (তথ্য সহায়তা - বরুণ দে, অভিজিৎ চক্রবর্তী, বিশ্বসিন্ধু দে)