ঈশ্বরচন্দ্রের হাতে তৈরি বীরসিংহ ভগবতী বিদ্যালয়। নিজস্ব চিত্র
সাধারণের শিক্ষার পুরোধা পুরুষ তিনি। অথচ তাঁর জন্মভিটের গ্রামেই শিক্ষার আলো তেমন উজ্জ্বল নয়। এ যেন সত্যি প্রদীপের নীচে অন্ধকার!
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গ্রাম ঘাটালের বীরসিংহ। তাঁর জন্মের দু’শো বছর উপলক্ষে এ বার আয়োজনের খামতি নেই। সামনের সপ্তাহে আসছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগে বীরসিংহের ক্ষোভে প্রলেপ দিতে হঠাৎ করেই বাড়তি তৎপর প্রশাসন। তবে সে সব ছাপিয়েও ধরা পড়ছে ‘শিক্ষার আঁধার’।
বীরসিংহ গ্রামে প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় মিলিয়ে মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তিনটি। একটি প্রাথমিক স্কুল, একটি মাধ্যমিক ও একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। তবে বীরসিংহের মাটিতে কোনও কলেজ নেই। এক সময় অবশ্য বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগরের নামাঙ্কিত একটি কলেজ ছিল। ১৯৪৯ সাল নাগাদ সেখানে পঠনপাঠনও শুরু হয়। যদিও পরের শিক্ষাবর্ষের মাঝেই বন্ধ হয়ে যায় সেই কলেজ। স্বাধীনতার পরপর সেই সময় বীরসিংহ ছিল অনেকটাই পিছিয়ে পড়া এলাকা। শিক্ষার হারও ছিল বেশ কম। তখনই বিদ্যাসাগরের গ্রামে মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে মাথা তুলেছিল এই কলেজ। তবে তার ঝাঁপ বন্ধ নিয়ে তেমন আলোড়ন হয়নি। বস্তুত বীরসিংহে যে এক সময় কলেজ তৈরি হয়েছিল সে কথা নতুন প্রজন্মের অনেকেরই অজানা।
বীরসিংহে বিদ্যাসাগরের নিজের হাতে গড়া ১৮৫৩ সাল থেকে পথচলা শুরু করা বীরসিংহ ভগবতী হাইস্কুল অবশ্য ঐতিহ্য হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর রয়েছে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত বীরসিংহ বিদ্যাসাগর বালিকা বিদ্যালয়। বালিকা বিদ্যালয়টি মাধ্যমিক স্তরের। মাধ্যমিকের পরে ছাত্রীরা হাইস্কুলেই ভর্তি হয়।
বিদ্যাসাগরের হাতে তৈরি ভগবতী হাইস্কুল এক সময় কৃতী ছাত্রছাত্রীদের বিচরণ ক্ষেত্র ছিল এই বিদ্যালয়। চালু হয়েছিল ছাত্রাবাস। স্কুলের কৃষি বিভাগও বেশ নামজাদা ছিল। বাইরের বহু ছাত্রও বীরসিংহের এই ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠানে পড়তে আসত। এই স্কুলের বহু প্রাক্তনীই বিখ্যাত চিকিৎসক, আইপিএস, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসনিক আধিকারিকের দায়িত্ব সামলেছেন। এই স্কুলে শিক্ষক রয়েছেন ২৪ জন। তবে গ্রন্থাগারিক নেই। পাঠাগারে যাওয়ার প্রবণতাও পড়ুয়াদের মধ্যে কম।
কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ততই সেই ঐতিহাসিক স্কুলের পঠনপাঠনের মান গিয়ে ঠেকছে তলানিতে। গ্রামের বাসিন্দাদের আক্ষেপ, বিদ্যাসাগরের গ্রাম দু’শো বছরে কতটা এগিয়েছে তা স্কুলের হাল দেখলেই মালুম হয়। পড়ুয়ার সংখ্যা কমছে। গোটা স্কুলে এখন আটশো ছাত্রছাত্রী। আর প্রতি বছর গড়ে মাধ্যমিকে বসছে ৩৫-৪০ জন। তবে জেলার মেধা তালিকায় এখন আর তেমন ঠাঁই হয় না এই স্কুলের পড়ুয়াদের। আর একাদশে তো ছাত্র ডেকে আনতে হচ্ছে। প্রধান শিক্ষক নিয়োগ না করে টিচার ইনচার্জ নিয়োগ করে স্কুলকে রাজনীতির আখড়া বানিয়ে ফেলা হয়েছে বলেও অভিযোগ অভিভাবক ও স্থানীয়দের। বীরসিংহ ভগবতী বিদ্যালয়ের টিচার ইনচার্জ শক্তিপদ বেরার অবশ্য যুক্তি, “চারদিকে অনেক স্কুল হয়ে গিয়েছে। তাই পড়ুয়া কমছে। তবে পঠনপাঠন ও স্কুলের ফল তো ভালই হয়।”
বালিকা বিদ্যালয়টির অবস্থা আরও করুণ। ছাত্রী প্রায় সাড়ে তিনশোজন। স্কুলে ক’দিন আগে পরিস্রুত পানীয় জলের পাম্প বসেছে। এখনও লাইব্রেরি, কমিউনিটি রুম, শিক্ষিকা ও ছাত্রীদের বসার জায়গার অভাব রয়েছে। নেই পর্যাপ্ত শৌচাগারও। ডাইনিং হলও নেই। স্কুলের বারান্দায় মিড ডে মিল খায় ছাত্রীরা। মাধ্যমিকে পাশের হার তুলনায় ভাল হলেও মেধা তালিকায় কখনই নাম তুলতে পারেনি এই স্কুলের ছাত্রীরা। বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মীরা রায় বলেন, “সম্প্রতি স্কুলের উন্নয়নে টাকা এসেছে। কাজও হচ্ছে।”
বীরসিংহের শিক্ষার অসুখ অবশ্য মানতে নারাজ প্রশাসন ও শাসকদল। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা স্কুল পরিদর্শক অমরকুমার শীলের দাবি, ‘‘বীরসিংহের দু’টি স্কুলেই পড়াশোনার মান খুব ভাল। পরিকাঠামোর কিছু খামতি থাকলে সমাধান করে দেওয়া হবে। এমনিতে তেমন কোনও সমস্যাই নেই স্কুল দু’টিতে।’’ আর ঘাটালের তৃণমূল বিধায়ক শঙ্কর দোলইয়ের বক্তব্য, ‘‘ভগবতী বিদ্যালয়ে পরিকাঠামোর কোনও সমস্যা নেই। আর বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কাজ চলছে।’’ দ্রুতই হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ হবে বলেও আশ্বাস তাঁর। (চলবে)