গোয়ালতোড় শিল্প তালুকে মাথা তুলছে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প। সরকারি বীজখামারের জমিতে সেই প্রকল্পে উপকৃত হবেন তো এলাকাবাসী? —ফাইল চিত্র।
১৯৬৫ সালে সরকারি উদ্যোগে গোয়ালতোড়ের জিরাপাড়া অঞ্চলের দুর্গাবাঁধে গড়ে তোলা হয়েছিল রাজ্যের সর্ববৃহৎ পাটবীজ উৎপাদন কেন্দ্র— ‘জুট সিড মাল্টিপ্লিকেশন ফার্ম’। কৃষি বিভাগের একজন সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন দায়িত্বে। খামারের এলাকা প্রায় হাজার একর।
রাজ্যের কৃষি বিভাগের এই খামারে গোড়ায় শুধুমাত্র পাটবীজই উৎপাদন হত। সেই বীজ হাওড়া, হুগলি, নদিয়া-সহ নদীমাতৃক জেলায় পৌঁঁছে যেত। পরে পাটের সঙ্গে অন্য কৃষিপণ্যের বীজও উৎপাদন শুরু হয়। বীজখামারের অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ কৃষি শ্রমিকেরা বলেন, প্রথম তিন দশকে রমরমা ছিল এই বীজখামারের। স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মী, কৃষি শ্রমিক, অফিসার—সব মিলিয়ে সে এক দক্ষযজ্ঞ।
এখন অবশ্য সে সব অতীত। বীজখামারের দুই স্থায়ী কর্মীর আক্ষেপ, ‘‘বীজখামারের পুরো জায়গাটাই দখল করে সোলার প্লান্ট হচ্ছে। আমাদের আর কী কাজ থাকল!’’ সত্যিই কাজ নেই। এই প্রথম এ বার কোনও বীজ উৎপাদন হচ্ছে না এখানে। গত বছর অল্প হলেও ধান, পাট, আলু, তিল বীজ উৎপাদন করেছিলেন কর্মী-শ্রমিকেরা। এ বার কিচ্ছু না। এই প্রথম বর্ষার আগে বীজ উৎপাদনের মরসুম শুরুর মুখে কাজ নেই এই খামারে। সে কথা মানলেন খামারের সুপার সামসুদ তাবেয়াত খান। তবে আর কিছু বলতে রাজি হলেন না।
গতবছরের গোড়ায় এই সরকারি বীজখামারের সব জমিটাই (প্রায় ৯৫০ একর) রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম থেকে নিয়েছে রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানি লিমিটেড (ডবল্যুবিএসএডিসিএল)। তাদের তত্ত্বাবধানে এখানে গড়ে উঠছে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প। বিদ্যুৎ দফতরের দাবি, পরিবেশবান্ধব এই প্রকল্পের সুবিধা পাবেন রাজ্যবাসী। তবে সেই ২০১৩ সাল থেকে এখানকার জমিতে শিল্প গড়ার কথা বলছে তৃণমূল সরকার। শিল্পতালুক করার ঘোষণাও হয়েছে। কখনও জমি পরিদর্শন করেছেন প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, কখনও বিদেশের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্প গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
এক সময় বলা হয়েছিল, এখানে এক লপ্তে প্রায় হাজার একর জমিতে হয় ভারী শিল্প, নয়তো ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প গড়া হবে। নিদেন পক্ষে এমএসএমই প্রকল্পে ছোট শিল্প, কলকারখানাও হতে পারে। ভূমি দফতর জমি দিয়েছিল রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমকে। এখন নিগম থেকে জমির মালিকানা গিয়েছে বিদ্যুৎ দফতরের হাতে। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের মতো এখানেও স্বপ্ন হয়েই থেকে গিয়েছে শিল্প।
শিল্পের বিকল্প হিসেবে এখন হচ্ছে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প। সূর্যের আলো থেকে সে বিদ্যুতে আলো জ্বললেও আঁধার ঘনাচ্ছে রকারি বীজখামারে। বেশ কিছু বছর ধরেই বীজ উৎপাদন কমছিল, শূন্যপদে নিয়োগ হচ্ছিল না, ভেঙে পড়া পরিকাঠামো মেরামতে সরকারি উদ্যোগ ছিল না। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ২০১৩-১৪ সাল নাগাদ একবার সরকারের নজর পড়েছিল বীজখামারের উপর। খামার বাঁচাতে নয়, শিল্প গড়তে।
একসময় সরকারি বীজখামারে স্থায়ী পদ ছিল ১০৫৬টি, এখন আছেন ২২জন স্থায়ী কর্মী। অস্থায়ী কর্মীর পদ প্রায় ৬৫০ হলেও আছেন মোটে ১৮ জন। খামারের এক প্রাক্তন কর্মী শোনালেন, ‘‘নতুন করে নিয়োগ আর হবে না। এই পদগুলিও অবলুপ্তির পথে। অথচ বেশিরভাগ স্থানীয়রাই এখানে কাজ করতেন।’’ তা ছাড়া, বীজখামার গড়ার উদ্দেশ্য ছিল চাষিদের সস্তায় বীজ সরবরাহ করা। খামার উঠে গেলে সেটাও হবে না। বীজখামারের কল্যাণে তফসিলি জাতি-উপজাতি অধ্যুষিত এই এলাকায় শিক্ষার হারও বেড়েছিল। এখানে একটা সময় প্রচুর জৈব সার উৎপাদন করা হত। স্থানীয় চাষিরা সেই কৌশল শিখে নিজেরা বাড়িতে সার তৈরি করতেন। এখন সারও উৎপাদনেও দাঁড়ি পড়েছে।
খামারের সর্বাঙ্গে এখন যেন জরা। বীজ মজুতের ৪টি গুদামঘরের মধ্যে ২টি আগেই ভেঙে ধান ও আলুবীজ খেয়ে তছনছ করেছে হাতি। সেই গুদামঘর মেরামত হয়নি। পাশেই ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে খামারে একদা ব্যবহৃত গাড়ি। বীজখামার এলাকার মধ্যেই সরকার পোষিত যে জুট সিড ফার্ম প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, সেখানে শিশু শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি সাকুল্যে পড়ুয়া ১১জন। দুই শিক্ষক রাজীব লোচন কারক ও দেবাশিস দাস বলছিলেন, ‘‘১৯৮০ সাল থেকে এই স্কুল চলছে। এত কম পড়ুয়া আগে কখনও হয়নি। অথচ মিড ডে মিল চালু আছে। স্কুলের পরিকাঠামোও মোটামুটি ঠিক আছে।’’ এখানে বীজখামারের কর্মী- শ্রমিকদের বাড়ির ছেলেমেয়েরাই মূলত পড়ত। সেই কর্মী সংখ্যাই যেখানে হাতেগোনা, স্কুলেও তো তার প্রভাব পড়বে।
বীজখামারের সুপার সামসুদ তাবেয়াত খানের দাবি, ‘‘পুরো বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আছে।’’ আর স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতো বলছেন, ‘‘দুর্গাবাঁধ বীজখামার অনেক আগে থেকেই বেহাল। বীজখামার যাতে নষ্ট না হয় তা গুরুত্ব দিয়েই দেখা হচ্ছে।’’
কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে কই! (শেষ)