এত বছর পরে ঘরে ফিরে মায়ের সঙ্গে সাফেকুল (ডানদিকে)। নিজস্ব চিত্র
এ যেন সিনেমার চিত্রনাট্যকেও হার মানায়। ১৮ বছর আগের হারানো ছেলেকে ফিরে পেলেন বৃদ্ধ বাবা-মা। কোলাঘাটের গোপালনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের বাথানবেড়িয়া গ্রামের ঘটনা। লক্ষ্মীপুজোর দিন ছেলেকে ফিরে পেয়ে খুশির জোয়ার পরিবারে।
কোলাঘাটের বাথানবেড়িয়া গ্রামের সৈয়দ আলি হায়দারের ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে চারজনই কথা বলতে পারে না (মূক)। আর এক ছেলে কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। বাড়ির সেজ ছেলে বছর তেরোর সৈয়দ সাফেকুল বাবার সঙ্গে ওড়িশায় কাঠের কাজ করত। ২০০১ সালে মূক সাফেকুল বাড়ির কাউকে কিছু না বলেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। বাড়ির লোকজন ছেলেকে ফিরে পেতে এনেক খোঁজাখুঁজি করেন। থানায় নিখোঁজ ডাইরিও করেছিলেন। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত কোনও কূলকিনারা না পেয়ে ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশা কার্যত ছেড়ে দিয়েছিলেন সাফেকুলের পরিবার। বছর কয়েক আগে সাফেকুলের এক প্রতিবেশীর মেয়ের বিয়ে হয় খড়গপুরে। সম্প্রতি নাজমা খাতুন নামে সাফেকুলের প্রতিবেশী ওই মহিলা সাফেকুলকে তাঁর শ্বশুরবাড়ি এলাকায় একটি বাড়িতে দেখতে পান। ১৮ বছরে মুখের গড়ন বদলে গেলেও সাফেকুলকে চিনতে ভুল হয়নি নাজমার। তিনি সঙ্গে সঙ্গে খবর দেন তাঁর বাপের বাড়িতে। গত বৃহস্পতিবার সাফেকুলের পরিবারের লোকজন চলে যান খড়গপুরের সাদাতপুর গ্রামে। বাবাকে দেখে চিনতে পেরে কেঁদে ফেলেন সাফেকুল। রবিবার সাফেকুলকে তাঁর কোলাঘাটের বাড়িতে পৌঁছে দিলেন পালক পিতা শেখ কওসর।
কী ভাবে সাফেকুলকে পেয়েছিলেন কওসর?
রবিবার সাফেকুলকে তাঁর বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে কওসর বলেন, ‘‘আঠারো বছর আগে খড়গপুর স্টেশনে ওকে কাঁদতে দেখেন তাঁর এক প্রতিবেশী। মূক সাফেকুল বাড়ির কথা বলতে না পাড়ায় ওই ব্যক্তি তাকে তাঁর সঙ্গেই নিয়ে আসেন। কিন্তু সাফেকুলকে প্রথমে কেউ বাড়িতে ঠাঁই দিতে চাননি। খড়গপুর এলাকার লোকজন সাফেকুলের ছবি দিয়ে খোঁজ চালান। কিন্তু তার পরিচয় জানা যায়নি।’’ অগত্যা এগিয়ে আসেন সাদাতপুর গ্রামের শেখ কওসর। নিজেরও একটি মূক মেয়ে থাকায় সাফেকুলের ওপর মায়া পড়ে যায় কওসর ও তাঁর স্ত্রী রশিদা বিবির। সন্তান স্নেহে তাঁরা বড় করতে থাকেন সাফেকুলকে। একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে সাফেকুলকে ভর্তিও করে দেন কওসর। সেখানে ব্রেইল পদ্ধতিতে দু’বছর পড়ার পর সাফেকুল গাড়ির গ্যারাজে কাজ করতে শুরু করে।
সাফেকুলের পিসতুতো দিদি নাজমার বিয়ে হয় কওসরের বাড়ির পাশেই। সম্প্রতি নাজমা সাফেকুলকে চিনতে পারেন। রবিবার কওসর নিজে সাফেকুলকে কোলাঘাটে তাঁর নিজের বাবা-মায়ের ড়িতে পৌঁছে দেন। বছর ৩১-এক সাফেকুলকে দেখতে এ দিন ভিড় উপচে পড়েছিল বাথানবেড়িয়া গ্রামে। চলে মিষ্টি মুখও।
সাফেকুলের বাবা সৈয়দ আলি হায়দার বলেন, ‘‘ছেলেকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছিলাম। ১৮ বছর পর ওকে ফিরে পেয়ে খুব ভাল লাগছে।’’ আর কওসরের কথায়, ‘‘ওকে ওর বাবা-মা’র কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে ভাল তো লাগছেই, তবে কষ্টও পাচ্ছি নিজেদের কথা ভেবে। এতদিন পরিচয় না জানায় ওর ভোটার কার্ড করতে পারিনি। এবার ওর সব কিছু হবে।’’ চোখে জল নিয়ে কওসরের স্ত্রী রশিদা বলেন, ‘‘ও যেন ভাল থাকে, সুস্থ থাকে।’’