গনগনির ভূমিক্ষয়। খাদের ঢাল বেয়ে নীচে নামছে জল। নিজস্ব চিত্র।
লাল আর গেরুয়া মাটির পাহাড়ে নিসর্গের ভাস্কর্য। পাথুরে পথ, রয়েছে সিঁড়ির খাঁজও। প্রকৃতির এই অপূর্ব সৌন্দর্য গড়বেতার গনগনিকে করে তুলেছে আমেরিকার ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে’র বঙ্গজ সংস্করণ।
রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত আর পাশে শিলাবতী নদীর আগ্রাসী রূপে সেই গনগনির ভূমিক্ষয়ই এখন রীতিমতো উদ্বেগের। জলের তোড়ে গলে যাচ্ছে ল্যাটেরাইট মাটি। নদীতে মিশছে রাঙা জল।
গত ২৯ ও ৩০ জুলাই টানা বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত গনগনির ভূমিরূপ। সঙ্গে জুড়েছে শিলাবতীর প্রবল জলের চাপ। গনগনিতে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ১৫৬ সেন্টিমিটার। কিন্তু এই দু’দিনে বৃষ্টি হয়েছে তার দ্বিগুণেরও বেশি। উঁচু মাটির ঢাল বেয়ে বৃষ্টির জল বয়েছে নীচে। শিলাবতী উপচেও হু হু করে জল ঢুকেছে খাদের ফাঁকে। ত্বরান্বিত হয়েছে ভূমিক্ষয়। এর ফলে গনগনি ভূমিরূপে পরিবর্তন আসতে পারে বলে আশঙ্কা ভূ-তাত্ত্বিকদের।
ভূমি বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছে, গনগনির ভূমিরূপ ক্ষয়িষ্ণু ঊষর। বহু বছর আগে কাঁকুরে পলল স্তরের উপর ক্রমান্বয়ে ঋতুগত ভৌমজলস্তরের ওঠানামায় আর্দ্রতা ও শুষ্কতার প্রভাবে তৈরি হয়েছে এই ল্যাটেরাইট। শিলাবতীর ডান পাড়ের অংশে সুউচ্চ খাড়া ঢাল বরাবর গভীর ক্ষয়ের ফলে অজস্র নালা ও তাদের সংযুক্তিতে এই ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়েছে। গনগনি নিয়ে চর্চা করা ভূমিরূপবিদ্যার গবেষক শুভেন্দু ঘোষ বলেন, ‘‘গনগনিতে ভূমিক্ষয় বাড়ছে। এখানে উপরের কঠিন স্তর এবং নীচে বালি-কাদা মিশ্রিত কোমল স্তর অবস্থান করে। ফলে উলম্বভাবে নেমে আসা নালী-প্রণালীগুলি সহজেই কোমলস্তরে ক্ষয় করে।’’ এই ক্ষয় হতে থাকলে গনগনির ভূমিরূপের গঠনশৈলীর পরিবর্তন ঘটতে পারে বলে মনে করেন তিনি। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের অধ্যাপক রামকৃষ্ণ মাইতি, যিনি গনগনির ভূমিরূপ নিয়ে গবেষণা করেছেন, তিনিও বলেন, ‘‘বৃষ্টি হলে ভূমিক্ষয় হবে। তা ভূমি বৈচিত্র্যে আকর্ষণ বাড়ায়। কিন্তু গনগনির মতো যেখানে নদী থেকে ভূমিভাগের উচ্চতা অনেক বেশি, সেখানে ক্ষয় হয় ভূমিভাগের নীচ থেকে, আর উপর থেকে ভূমিভাগ ধসে পড়ে। গনগনিতেও তাই হচ্ছে।’’
ইতিমধ্যে গনগনিতে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। প্রাথমিক প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে। তারই মধ্যে ভূমিরূপের বদলের শঙ্কা শোরগোল ফেলেছে। এখানে প্রায়ই আসেন পরিবেশপ্রেমী গড়বেতা হাইস্কুলের ভূগোলের শিক্ষক সুব্রত নিয়োগী। তিনিও বলেন, "ভূমিক্ষয়ের এই ব্যাপক প্রবণতায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে খাদগুলির একটার পর একটা অংশ। ক্ষতি হচ্ছে গনগনির আসল রূপের।’’ শিলাবতীতে নিয়মিত মাছ ধরেন স্থানীয় ষষ্ঠী মাঝি, অরুণ মাঝিরা। তাঁদেরও পর্যবেক্ষণ, ‘‘নদী অনেকটা গনগনির ভিতরে ঢুকে গিয়েছে। ভেঙে যাচ্ছে খাদের অংশ। কয়েকবছর আগেও এই অবস্থা ছিল না।’’
শিলাবতীর গতিপথ বদল এ ক্ষেত্রে চিন্তা বাড়াচ্ছে। গনগনির আশেপাশে এখন বালি খাদান নেই। তবে নদীর উপরের অংশে বালি তোলা হত একসময়। নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বলছেন, ‘‘বালি কেটে তোলার উপর নদীর গতিপথের হেরফের হতে পারে।’’
গনগনির নিসর্গ রক্ষায় তাই ভূমিক্ষয় রোধ জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অধ্যাপক রামকৃষ্ণ মাইতির পরামর্শ, নদীর তীর বরাবর চেকড্যাম করা যেতে পারে। প্রচুর গাছ বা জুন জাতীয় ঘাস লাগানো যেতে পারে। বৃক্ষরোপণও দরকার। জিয়োলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক মেদিনীপুরের শিখেন্দ্রকিশোর দে মানছেন, ‘‘গনগনির মতো স্থান ‘ব্যাডল্যান্ড’। এখানে ভূমিরূপ সদা পরিবর্তনশীল। ভূমিক্ষয় আটকানো না গেলে গনগনির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিনষ্ট হতে পারে।’’
গড়বেতার বিধায়ক তথা পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সভাধিপতি উত্তরা সিংহ হাজরার আশ্বাস, ‘‘এখানকার ভূমিরূপ, তার ক্ষয়, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা— সবই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। শীঘ্রই প্রশাসনিক স্তরে এ নিয়ে আলোচনা করব।’’