অঙ্কন: অমিতাভ চন্দ্র
ঘরের লোকের সঙ্গে লড়তে হলে জীবনটা কঠিন হয়। আর সেই লোকটা যদি হয় নিজের লোক তাহলে কাউকে কিছু বলার থাকে না। খালি কান্না বুকের ভিতরে ঠেলা মারতে থাকে। আমাকে যে লড়তে হয়েছিলস্বামীর সঙ্গেই।
আমি কে?
আমি সীতা আদক (নাম পরিবর্তিত)। একজন ফুল ব্যবসায়ী আমি। ফুল ব্যবসা দিয়ে কিন্তু আমার জীবনের লড়াই শুরু হয়নি। লোকের বাড়িতে কাজ করে শুরু হয়েছিল। গোড়া থেকেই বলি তা হলে। সবটা না শুনলে বোঝা যাবে না অনেক কিছু। আমার বাপের বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর এলাকায়। কোলাঘাটের পুলশিটা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার কুমারহাটে আমার বিয়ে হয়। আমার স্বামী ফুলের ব্যবসা করতেন। দুই ছেলে, দুই মেয়ে আমার। আজ থেকে ২৫ বছর আগের কথা। ছেলে মেয়েরা তখন খুব ছোট। স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে যান। কী যে মুশকিলে পড়েছিলাম সেই সময়ে! কী করে সংসার চালাব? ছেলে মেয়েগুলোকে মানুষ করব কী ভাবে? তখন লোকের বাড়ি কাজ শুরু করি। খেয়ে পরে বাঁচতে হবে তো! ছোট ছোট ছেলে মেয়েগুলোকে বাঁচাতে হবে। একা মেয়ের লড়াই যে কত শক্ত সেটা যারা এমন অবস্থায় পড়েতারাই বোঝে।
পেটের ভাতের কিছু একটা ব্যবস্থা হল বটে। কিন্তু বিপদ কাটল না। অন্য দিক থেকে আক্রমণ এল। আমাকে এখান থেকে উচ্ছেদ করার জন্য স্বামী নানা ভাবে চাপ দিতে শুরু করলেন। ভিটে ছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে তমলুক আদালতে মামলা করি আমি। মামলায় হার হবে বুঝতে পেরে স্বামী আমার নামে বাস্তুভিটে রেজিস্ট্রি করে দিতে রাজি হন। আমি নিজের নামে রেজিস্ট্রি করাইনি। বাস্তুভিটে দুই ছেলের নামে রেজিস্ট্রি করে দিই।
লোকের বাড়ি কাজ করে কি এতগুলো পেট চালানো যায়? পড়শিদের কয়েকজন পরামর্শ দিল ফুলের ব্যবসা করতে। তাতে সুবিধে হবে। তাদের পরামর্শে লোকের বাড়ির কাজ ছেড়ে ফুলের ব্যবসা শুরু করি। খুব খাটুনির কাজ ফুলের ব্যবসায়। দেউলিয়া ফুলবাজার থেকে ফুল কিনি। তার পর সেই ফুল নিয়ে গিয়ে হাওড়ার মল্লিকঘাট ফুলবাজারে বিক্রি করি। ২৫ বছর ধরে ফুলের ব্যবসা করছি। লকডাউনের সময় কিছুদিন ব্যবসা বন্ধ ছিল। তা ছাড়া বন্ধ নেই আমার কাজ। এখন পুজোর মরসুম। ফুলের খুব চাহিদা। প্রতিদিন রান্না করে খেয়ে সকাল ১১টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। দেউলিয়া ফুলবাজারে ফুল আর ফুলের মালা কিনি। তার পর গাঁট সাজাই। ফুলের গাঁট বওয়ার লোক আছে। তাদের দিয়ে গাঁট বাসের ছাদে তুলি। বাসে করেই হাওড়ায় যাই। সেখানে পৌঁছে আবার লোকের সাহায্য লাগে। তাকে দিয়ে বাসের ছাদ থেকে ফুলের গাঁট নামাই। তার পর ফুলবাজারে বসে ফুল বিক্রি করি। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রোজ রাত ৯টা বেজে যায়।
ফুলের ব্যবসা করে একটি পাকা বাড়ি তৈরি করেছি। ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। পাকা বাড়িতে ছেলে, বৌমা ও নাতনিরা থাকে। আমি মাটির বাড়িতেই থাকি। বড় ছেলে সোনার কাজ করে। ছোট ছেলে ফুলের কাজ করে। দু’জনেই ভিনরাজ্যে থাকে। আমার বয়স এখন ৫৩। ফুলের ব্যবসায় রোজ গড়ে ২০০-৩০০ টাকা আয় করি আমি। ছেলেদের সংসারে আমি বোঝা নই। হতেও চাই না। বরং ওদের কোনও প্রয়োজন পড়লে আমি এখনও টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করি। আমার ভাল লাগে ওদের পাশে দাঁড়াতে পারলে।
আমাদের মতো লোকেদের আলাদা করে পুজোর আনন্দ নেই। পথ চলতে চলতেই যেটুকু আনন্দ। পুজোর দিনগুলোতেও ব্যবসা বন্ধ থাকবে না যে! বাসে করে হাওড়ায় যাতায়াতের পথেই ঠাকুর দেখা হয়ে যাবে। ওই আমাদের আনন্দ। নিজের লোক পাশে থাকেনি। অথচ রক্তের যোগ নেই এমন লোকজনের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে যা কখনও শেষ হয়নি। আমি এক বাড়িতে এক সময় কাজ করতাম। ঝিয়ের কাজ বলে যাকে। সেই পরিবার প্রতি বছর পুজোতে আমাকে নতুন শাড়ি দেয়। এবারও দিয়েছে। কত রকম মানুষই তো দেখলাম দুনিয়ায়!
জীবন আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। ফুলের ব্যবসা শুরু করার আগে ভাবতাম আমি কি পারব? কিন্তু পরিস্থিতি আমাকে শক্ত করেছে। কঠিন সময়ে লড়তে পেরেছি। আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। মনে করি, তিনিই আমায় শক্তি দেন। আমি শুধু একটাই প্রার্থনা করি, দুঃখ যতই আসুক তুমি আমায় শক্তি দাও। আমি যেন লড়াইকরতে পারি।
অনুলিখন: দিগন্ত মান্না