প্রতীকী ছবি।
কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বেহুন্দি’ এবং ‘ইন্টিগ্রেটেড মেরিন ফিশারিজ ডেভলেপমেন্ট’ প্রকল্প ৬-এ মৎস্যজীবীরা ঋণ না নিলেও তাঁদের একাংশকে ঋণ শোধ বাবদ ভর্তুকির টাকা বিলির অভিযোগ উঠেছিল আগেই। এ বার মৎস্যজীবীদের সেই ঋণদান প্রকল্পে বেনিয়মের অভিযোগ তুলে সরব হলেন দুই মৎস্যজীবী।
কাঁথি-৩ ব্লকের সুকুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা শক্তিপদ দাস এবং সুচেতা সাহু, দুজনেই ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর নন্দীগ্রামের প্রশাসনিক সভায় মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে যন্ত্রচালিত বোট (৬ সিলিন্ডার যুক্ত) কেনার জন্য ঋণ বাবদ ৯.৯৫ লক্ষ টাকার চেক পেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে অর্ধেকেরও কম পরিমাণ টাকা পাওয়ায়, সন্দেহ হয় তাঁদের। দু’জনেই মুখ্যমন্ত্রী এবং পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসকের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ জানিয়েছেন। অভিযোগ পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। ইতিমধ্যে শুকদেবকে সমস্ত প্রামাণ্য নথি নিয়ে মারিশদা থানায় ডেকে পাঠানো হয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রে খবর।
যন্ত্রচালিত বোটের মালিক সুচেতার অভিযোগ, কয়েক দফায় মাত্র ৩ লক্ষ টাকা পেয়েছি। বাকি টাকা নিউ জলধা মেরিন ফিশারিজ কোপারেটিভ সোসাইটি পরে দেবে জানিয়েছিল। কিন্তু তা না পাওয়ায় জেলাশাসকের কাছে অভিযোগ জানাতে বাধ্য হই। প্রসঙ্গত, সুচেতা এই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্য। একই অভিযোগ আর এক সদস্য শক্তিপদরও। তাঁর অভিযোগ, ‘‘পুরো টাকা তো পাই-ইনি। তা ছাড়া আমার নামের কত টাকা ঋণ ও ভর্তুকি মঞ্জুর হয়েছিল সে সম্পর্কেও কিছু জানানো হয়নি। প্রাথমিক মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি আমাকে ঠকিয়েছে। তাই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছি।’’
একই অভিযোগ করে দাদনপাত্রবাড়ের এক মৎস্যজীবীর অভিযোগ, ভর্তুকি বাবদ মাত্র দশ হাজার টাকা নগদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে প্রশাসনিক সূত্রে জানতে পারি তিনি জানাতে পারেন তাঁর নামে কুড়ি লক্ষ টাকার ঋণ এবং প্রায় দশ লক্ষ টাকার ভতুর্কি অনুমোদন করেছিল বেনফিশ। বাকি টাকা কোথায় গেল তার হিসেব জানতে মৎস্য দফতর এবং জেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় সরকার ‘বেহুন্দি’ প্রকল্পে মাছ ধরার জাল এবং যন্ত্রচালিত বোট (২ সিলিন্ডার) কেনার জন্য ঋণ ও ভর্তুকি দিয়েছিল রাজ্য সরকারকে। বেনফিশ-এর মাধ্যমে ওই ঋণ প্রাথমিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিগুলির মারফত ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা। কিন্তু ওই প্রকল্পে আগেই দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছিল। অনেকেই নিজেদের অজান্তে ঋণের জালে জড়িয়েছিলেন। এ বার কেন্দ্রের আরেকটি প্রকল্প ‘ইন্টিগ্রেটেড মেরিন ফিশারিজ ডেভলপমেন্ট, ফেজ-৬’ প্রকল্পে একই দুর্নীতির অভিযোগ উঠল।
কী ভাবে দুর্নীতি হয়েছে?
দেখা গিয়েছে, প্রাথমিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিগুলি ঋণ দেওয়ার জন্য পছন্দের বোট মালিকদের নিয়ে নিজেরাই গোষ্ঠী তৈরি করে ফেলেছে। এক একটি গোষ্ঠীতে ১০ জন করে সদস্য রয়েছেন। কিন্তু কারা ওই গোষ্ঠীর সদস্য অনেকেই তা জানেননা। এ বার সদস্যদের তালিকা বেনফিশকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এবং সেই হিসেবে প্রাথমিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির কাছে ঋণের টাকা পৌঁছে দেয় রাজ্য সরকার। দেখা গিয়েছে, মৎস্যজীবী নন এমন অনেকেও সদস্য তালিকায় রয়েছে।
পূর্ব মেদিনীপুর মৎস্যজীবী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শ্রীকান্ত দাস বলেন, ‘‘সমুদ্রে গত কয়েক বছরে মাছ নেই বললেই চলে। তাই প্রাথমিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিগুলি মারফত মৎস্যজীবীদের ঋণ দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু যা পরিস্থিতি তাতে মৎস্যজীবীরা বঞ্চিত এবং প্রতারিত। একই রকম রকমের দুর্নীতি দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলাতেও হয়েছে। তাই আমরা রাজ্যস্তরে সংগঠনের মাধ্যমে বৃহত্তর আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’
কাঁথি মহকুমা খটি মৎস্যজীবী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত খুটিয়া বলেন, ‘‘তিন বছর আগে থেকেই আমরা মৎসজীবীদের সঙ্গে যে দুর্নীতি হয়েছে তার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিলাম। কিন্তু প্রশাসন আমাদের অভিযোগকে গুরুত্ব না দেওয়ায় আমরা মৎস্য খটিগুলিতে প্রচার করছি। যাতে সাধারণ মৎস্যজীবীরা সচেতন হন।’’
সুচেতা ও শক্তিপদর অভিযোগ নিয়ে, রামনগরের নিউ জলধা মেরিন ফিশারিজ কোপারেটিভ সোসাইটি তথা কাঁথি কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি লক্ষীনারায়ণ জানা বলেন, ‘‘যেহেতু বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। তাই এখন এ ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না।’’ পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক পার্থ ঘোষ বলেন, ‘‘এ ধরনের অভিযোগ পেয়েছি। মৎস্য দফতরকে বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে বলা হয়েছে।’’