গুলিচালনার অভিযোগ ঘিরে কংগ্রেস-সিপিএম এক সুরে তীব্র আক্রমণ করতে শুরু করল রাজ্যের প্রশাসন এবং শাসক দলকে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সিএএ বিরোধী জমায়েতের উপরে গুলিচালনার অভিযোগ ঘিরে উত্তপ্ত হতে শুরু করল গোটা বাংলার রাজনীতি। কংগ্রেস-সিপিএম এক সুরে তীব্র আক্রমণ করতে শুরু করল রাজ্যের প্রশাসন এবং শাসক দলকে। রাজ্যের সর্বত্র আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ার অভিযোগ তুলে আক্রমণে নামল বিজেপি-ও। কিন্তু সিএএ বিরোধীদের গুলি করে মারার নিদান দিয়ে যে মন্তব্য রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ করেছেন সম্প্রতি, সে প্রসঙ্গ টেনে বিজেপি-কেও বিঁধতে শুরু করলেন সোমেন মিত্র, মহম্মদ সেলিমরা। তৃণমূল অবশ্য গুলিচালনার সঙ্গে দলের যোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে।
বহরমপুরের সাংসদ তথা লোকসভার কংগ্রেস দলনেতা অধীর চৌধুরী থেকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র, সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম থেকে রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র— রাজ্যের বিরোধী দলগুলির এই শীর্ষ নেতারা সরব হয়েছেন জলঙ্গির ঘটনা নিয়ে। কংগ্রেস এবং বামেদের তরফে তীব্র আক্রমণ করা শুরু হয়েছে রাজ্য সরকারকে। আক্রমণ বিজেপি-ও করছে। তবে, সে আক্রমণ সিএএ বিরোধী জমায়েতে গুলিচালনার বিরুদ্ধে ঠিক নয়। বিজেপি-র আক্রমণ মূলত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ার অভিযোগ তুলে।
এ দিন সকালে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)-র প্রতিবাদে মুর্শিদাবাদের জলঙ্গিতে স্থানীয় ভাবে বন্ধ ডাকে ‘নব জাগরণ’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। তৃণমূল এবং বন্ধ সমর্থনকারীদের সংঘর্ষে সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান দু’জন। গুলিতে আহত হন বেশ কয়েক জন। স্থানীয়দের অভিযোগ, শাসক দলের স্থানীয় নেতৃত্বের উপস্থিতিতে বন্ধ সমর্থনকারীদের উপর এলোপাথাড়ি গুলি চালায় কিছু দুষ্কৃতী।
আরও পড়ুন: জলঙ্গিতে সিএএ-বিরোধী বন্ধে গুলি, মৃত ২, অভিযুক্ত তৃণমূল
তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জেলা সভাপতি তথা মুর্শিদাবাদের সাংসদ আবু তাহেরের দাবি, অরাজনৈতিক সংগঠনের নামে বন্ধের ডাক দেওয়া হলেও, আসলে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কংগ্রেস এবং বামেরা ছিলেন। তাহেরের আরও দাবি, পিএফআই এবং মিমের মতো কট্টর সাম্প্রদায়িক সংগঠনের লোকজনও ওখানে জমা হয়েছিলেন এবং তাঁরাই অশান্তি পাকিয়েছেন। তাঁর দলের কেউ হামলা করেনি বা গুলি চালায়নি বলে তৃণমূল জেলা সভাপতির দাবি।
সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম পত্রপাঠ নস্যাৎ করছেন সে তত্ত্ব। সেলিম বলছেন, ‘‘দিলীপ ঘোষ যা করবেন বলেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার আসলে তা-ই করছে। তৃণমূল এবং বিজেপি যে হাত ধরাধরি করে চলছে, তা বুঝতে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’’ দিন পনেরো আগে রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি দিলীপ ঘোষ রানাঘাটে এক জনসভায় বলেছিলেন, বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় এলে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংসকারীদের গুলি করে মারা হবে। সেই প্রসঙ্গ তুলেই সেলিম এ দিন তৃণমূল এবং বিজেপি-কে এক সঙ্গে বিঁধতে চেয়েছেন।
সেলিমের এই তত্ত্বকে ‘হাসির খোরাক’ বলে দাবি করছে বিজেপি। রাজ্য বিজেপি-র সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বলেছেন, ‘‘রাজ্যে একের পর এক নির্বাচনে হেরে সম্পূর্ণ ধরাশায়ী হয়ে গিয়ে মহম্মদ সেলিমদের মতো সিপিএম নেতাদের মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটেছে। সেলিম আগে চিকিৎসা করিয়ে আসুন। তার পরে এই সব বিষয় নিয়ে কথা বলবেন। আমি ওঁর সুস্থতা কামনা করি।’’
আরও পড়ুন: বেপরোয়া গাড়ি বাসন্তী হাইওয়ের খালে, ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় উদ্ধার ৩ আরোহী
কিন্তু, সায়ন্তন যা-ই বলুন, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের বয়ানও প্রায় হুবহু মিলছে সেলিমের সঙ্গে। তিনি এ দিন বলেছেন, ‘‘যে ভাবে সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের উপর রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের নেতৃত্বে বোমা-গুলি চালিয়ে তাঁদের প্রাণে মেরে ফেলা হল, তাতে আবার এটাই প্রমাণ হল যে, উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারের সঙ্গে এ রাজ্যের ‘দিদি’র সরকারের কোনও ফারাক নেই। উভয় দল এবং সরকারই একই মুদ্রার দুই পিঠ মাত্র।’’
মুর্শিদাবাদের সবচেয়ে হেভিওয়েট রাজনীতিক অধীর চৌধুরী এই ঘটনার দিন দিল্লিতে। সেখান থেকেই অধীর এ দিন তীব্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। তাঁর বিস্ময়, ‘‘যে নাগরিক আইনের বিরোধিতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে করেন, সেই আইনের বিরোধিতা যখন সাধারণ মানুষ করছেন, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লোক সেখানে হামলা করছে কেন!’’ লোকসভার কংগ্রেস দলনেতার ব্যাখ্যা, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব সময় বলেন, আন্দোলন করো, কিন্তু বন্ধ পালন করা চলবে না। রাস্তা অবরোধ করা চলবে না। অথচ, এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারা জীবন ধরে বন্ধ পালন করেছেন, রাস্তা অবরোধ করছেন, বিধানসভা ভেঙেছেন, বাস রুখেছেন, বাসে আগুন লাগিয়েছেন, রাইটার্স বিল্ডিয়ের সামনে আন্দোলন করে ১৩টা যুবকের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তখন তাঁর কিছু ভুল ছিল না। কিন্তু, আজ যাঁরা আন্দোলন করার সময় বন্ধ পালন করার দাবি জানাচ্ছেন, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখে তাঁরা বিদ্রোহী, তাঁরা সমাজবিরোধী, তাঁরা শত্রু।’’ অধীরের কথায়, ‘‘মমতার সেই মানসিকতাকে কাজে লাগিয়েই মুর্শিদাবাদের স্থানীয় তৃণমূল নেতারা সাধারণ মানুষের উপরে হামলা চালালেন এবং মৃত্যু হল।’’ জেলা প্রশাসনকে তীব্র আক্রমণ করে অধীর বলেছেন, ‘‘ওখানকার প্রশাসনের একটাই কাজ, কংগ্রেসকে দুর্বল করো, বামপন্থীদের দুর্বল করো, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শক্তিশালী করো। ফলে, বাকি যা কিছু হবে হোক, তাঁদের মাথাব্যথা নেই। প্রশাসনের এই নির্বিকার আচরণের কারণে দিনদুপুরে এই রকম একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল।’’
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বিজেপি-র সায়ন্তন বসুর মতও কিন্তু অধীরের সঙ্গে মিলছে। মুর্শিদাবাদ-সহ গোটা রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে বলে তাঁর দাবি। তবে, সায়ন্তন আরও একটি তত্ত্ব এ দিন খাড়া করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, জলঙ্গিতে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে স্থানীয় তৃণমূলের সংঘর্ষ হয়েছে।’’
আরও পড়ুন: নিয়ম না মেনেই কুণালের উপর নিষেধাজ্ঞা? বিমান সংস্থার সিদ্ধান্তে উঠছে প্রশ্ন
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, ‘‘রাজ্য সরকার এবং রাজ্যের শাসকদল মুখে সিএএ বিরোধিতার কথা বললেও বারে বারে এ রাজ্যে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে মোদী সরকারের হয়েই দমনমূলক ভূমিকা নিয়েছে। প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ করতে বিজেপির হয়ে মাঠে নেমেছে তারাই। এ দিন তৃণমূল নেতার উপস্থিতিতে তাদের দুষ্কৃতীবাহিনীর গুলিতে যে ভাবে দু’জনের প্রাণহানি ঘটেছে আমরা তার তীব্র নিন্দা করছি।’’