মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
নিয়োগ দুর্নীতিতে প্রায় ২৬ হাজার চাকরি বাতিলের ‘দায়’ পুরোপুরি বিজেপি এবং সিপিএমের উপরেই চাপালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর নবান্নে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু, মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ, শিক্ষাসচিব এবং রাজ্য সরকারের নিযুক্ত আইনজ্ঞদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন মমতা। তার পরে সাংবাদিক বৈঠকে দুই বিরোধী দলের উদ্দেশে তোপ দাগেন। কোনও রাখঢাক না করে নাম করেই আক্রমণ করেন তিন সাংসদকে, যাঁদের মধ্যে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। মমতার প্রশ্ন, কোনও বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তাঁর ‘শাস্তি’ যদি বদলি হয়, তা হলে পশ্চিমবঙ্গে এসএসএসি-র ক্ষেত্রেও সেই নীতি কেন নেওয়া হল না? মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘আমি বিশ্বাস করি এটা বিজেপি করিয়েছে! সিপিএম করিয়েছে।’’ কারণ, তারা বাংলার শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে চায়।
সাংবাদিক বৈঠকে প্রথমে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের উপসংহারের অংশবিশেষ পড়ে শোনান মুখ্যমন্ত্রী। তার পরেই সরাসরি প্রশ্ন তোলেন বিজেপি-সিপিএমের ভূমিকা নিয়ে। মমতা বলেন, ‘‘আমি অবাক হয়ে যাই! এখানে মামলাটা করেছিলেন কে? বিকাশবাবু (সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ তথা আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য)। তিনি তো পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম আইনজীবী! তিনি কেন এখনও নোবেল পাচ্ছেন না আমি জানি না! পাওয়া উচিত। ভাবছি একটা সুপারিশ করব।’’ মুখ্যমন্ত্রীর কটাক্ষের জবাব দিয়েছেন বিকাশ। তাঁর কথায়, ‘‘নোবেল দিলে দিক না! তবু তো একটা কিছু পেতে পারি। লোকে বিপদে পড়লে ঈশ্বরের নাম নেয়। তৃণমূল আমার নাম নিচ্ছে।’’
সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষিত হওয়ার পরেই রাজ্য বিজেপির সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার আক্রমণ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে। সুকান্ত বলেছিলেন, ‘‘যোগ্য আর অযোগ্যদের মধ্যে ফারাক করা যায়নি বলেই সবার চাকরি চলে গেল। আদালত বার বার বলেছিল, যোগ্য-অযোগ্য বাছাই করে দিতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কিছুতেই সেটা করেনি। সেই জন্যই চাকরি গিয়েছে। এত জনের চাকরি চলে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি দায়ী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’ সুকান্তের কথায়, ‘‘নিয়োগ দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে এর আগে একজন মুখ্যমন্ত্রী জেলে গিয়েছিলেন। তিনি হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, ওমপ্রকাশ চৌটালা। এ বার আরও একজন মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগ দুর্নীতির দায়ে জেলে যাবেন। তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে, তাতে একা পার্থ চট্টোপাধ্যায় দায়ী হতে পারেন না। মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর পুরো ক্যাবিনেটের জেলে থাকা উচিত।’’
সুকান্তের এই মন্তব্য নিয়েও মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক বৈঠকে প্রশ্ন তোলেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘এতগুলো মানুষের চাকরি যাওয়ার পরে বিজেপির মন্ত্রী সুকান্তবাবু বলছেন, অযোগ্যদের জন্য যোগ্যদের চাকরি গিয়েছে। এর জন্য আমি নাকি দায়ী!’’ মুখ্যমন্ত্রীর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘আপনারা প্রথমে যখন মামলা করলেন, তখন একবার ভেবে দেখলেন না, কারা যোগ্য আর কারা অযোগ্য? সেটা তো সরকারকে ভাবতেও দিলেন না। আপনারা নিজে যোগ্য তো?’’
তমলুকের বিজেপি সাংসদ তথা কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কেও মুখ্যমন্ত্রী বৃহস্পতিবার নিশানা করেছেন। যদিও তাঁর পুরো নাম করেননি মমতা। বলেছেন, ‘‘হাই কোর্টে এই রায় প্রথম যিনি দিয়েছিলেন, তিনি এখন বিজেপির সাংসদ হয়েছেন। বিচারবিভাগ ছেড়ে দিয়ে বিজেপির সাংসদ হয়েছেন। গাঙ্গুলি না ডাঙ্গুলি! দুঃখিত, আমি ঠিক জানি না তাঁর আসল নামটা। পরে জেনে নেব।’’ এর পরেই মমতার প্রশ্ন, ‘‘আজ তাঁরা কোন মুখে বড় বড় কথা বলেন? আমি বিশ্বাস করি এটা বিজেপি করিয়েছে, সিপিএম করিয়েছে।’’
মুখ্যমন্ত্রীর ইঙ্গিত, ‘রাজনৈতিক অভিসন্ধি’ নিয়ে বাংলাকে আক্রমণ করা হচ্ছে। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘সব সময় বাংলাকে কেন টার্গেট (লক্ষ্য) করা হবে? কী দোষ করেছে বাংলার ছেলেমেয়েরা? কী দোষ করেছে বাংলার ছাত্র-যুবরা?’’ স্কুল-কলেজ মিলিয়ে রাজ্যে এখনও এক লক্ষ পদে নিয়োগ বাকি বলে সাংবাদিক বৈঠকেই জানান মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশিই জানান, নিয়োগ নিয়ে এই মামলা চলছিল বলেই এত দিন ওই নিয়োগ করা যাচ্ছিল না। এর পরে ওই বকেয়া নিয়োগের দিকে তিনি মন দেবেন।
সম্প্রতি দিল্লি হাই কোর্টের যে বিচারপতির বাড়ি থেকে বিপুল নগদ অর্থ উদ্ধারের অভিযোগ উঠেছিল, সেই বিচারপতির ‘শাস্তি’র প্রসঙ্গও মমতা টেনে আনেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমার একটা প্রশ্ন আছে। আমি ভুল হতে পারি। কিন্তু আমার মনে এই প্রশ্নটা এসেছে। একজন বিচারকের বাড়ি থেকে যদি ১৫ কোটি টাকা পাওয়া যায়, যেটা জানতে পেরেছি এখনও, আর তার শাস্তি যদি বদলি হয়, তা হলে আমার এই ২৫ হাজার ভাইবোনকেও বদলি করতে পারত।’’ তিনি যে সচেতন ভাবেই দু’টি বিষয়ের তুলনা করছেন, সে কথাও মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দেন। বলেন, ‘‘আমি ভুল হতে পারি। কিন্তু এই দুটো বিষয়কে আমি মিলিয়েই দেখছি।’’
এর পরেই এত চাকরি একসঙ্গে বাতিলের নেপথ্যে ‘রাজনৈতিক অভিসন্ধি’ থাকার ইঙ্গিত দেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘যাঁদের (চাকরি) বাতিল করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১১,৬১০ জন নবম এবং দশম শ্রেণিতে পড়াতেন। ৫,৫৯৬ জন একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াতেন। আপনারা জানেন, নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা উচ্চশিক্ষার প্রবেশদ্বার (গেটওয়ে)। (বাতিল হওয়া শিক্ষকদের) অনেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের খাতা দেখছিলেন। ২৫ হাজার শিক্ষককে বাদ দিয়ে দিলে পড়াবে কে? বিজেপি-সিপিএম কি শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে চাইছে? আপনাদের একবার লজ্জাও হল না?’’ বাম জমানার বিভিন্ন নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের সাবেক শাসকদলের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন, ‘‘সিপিএম নিজের আমলে কী করতেন? চিরকুটে চাকরি দিতেন!’’ সিপিএমের দলীয় মুখপত্রে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের প্রত্যেকের পরিবারের লোকজনকে চিরকুটে সরকারি চাকরি দেওয়া হয়েছে বলেও মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘‘কই তাদের তদন্ত তো হয় না! বিজেপির রাজ্যে তো তদন্ত হয় না! শুধু বাংলার ভাগ্যে দুর্ভোগ কেন থাকবে? বাংলায় জন্মানো কি অপরাধ? না কি বাংলার মেধাকে ওরা ভয় পায়?’’ একসঙ্গে এত শিক্ষকের চাকরি বাতিল করা ‘বাংলাকে পিছিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা’ হতে পারে বলে মুখ্যমন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠক শেষ হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই তাঁকে পাল্টা আক্রমণ করেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎকে যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রী নিশানা করেছেন, শুভেন্দু তার সমালোচনা করেন। বিচারপতি থাকাকালীন অভিজিতের রায়কে যে আগে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলা হয়েছিল, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে শুভেন্দু বলেন, ওই রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়েও রাজ্য সরকারের কোনও লাভ হয়নি। বিরোধী দলনেতার কথায়, ‘‘রাজ্য সরকার কিছুতেই যোগ্য-অযোগ্য বাছাই করে দেয়নি। সুপ্রিম কোর্টও বার বারই রাজ্য সরকার এবং এসএসসির আইনজীবীকে যোগ্য-অযোগ্য বাছাই করার সুযোগ দিয়েছে। আমরা বিধায়কেরাও এসএসসিতে স্মারকলিপি দিয়ে বলেছিলাম ৬-৭ হাজার অযোগ্যকে চিহ্নিত করুন। বাকি ১৮ হাজার যোগ্যকে বাঁচান। কিন্তু রাজ্য সরকার কিছুতেই এদের আলাদা করল না।’’