ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
ত্রিপুরায় তখন ভরা বাম জমানা। মুখ্যমন্ত্রী সিপিএমের মানিক সরকার। ২০১০ এবং ২০১৩ সালে দু’দফায় স্কুলশিক্ষার বিভিন্ন স্তরে শিক্ষক পদে ১০,৩২৩ জনকে নিয়োগ করেছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ওই নিয়োগ নিয়ে মামলা হয় ত্রিপুরা হাই কোর্টে। গোটা প্যানেল বাতিল করেছিল আগরতলার উচ্চ আদালত। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল মানিকের সরকার। কিন্তু ২০১৭ সালে শীর্ষ আদালতও সমগ্র প্যানেল বাতিলের নির্দেশই বহাল রাখে। ঘটনাচক্রে, তার পরের বছরই ছিল ত্রিপুরার বিধানসভা ভোট। যে ভোটে পড়ে গিয়েছিল মানিক-সরকার।
বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট বাংলার প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল করেছে। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতা হাই কোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছিল, এক বছর পরে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্নার বেঞ্চ কার্যত তা-ই বহাল রেখেছে। ঘটনাচক্রে, আগামী বছর বাংলায় বিধানসভা ভোট। ত্রিপুরার সেই ঘটনার নিরিখে তৃণমূলের জন্য সুপ্রিম কোর্টের বৃহস্পতিবারের নির্দেশ কি উদ্বেগের?
তবে একই সঙ্গে এই তথ্যও প্রণিধানযোগ্য যে, ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যা কম-বেশি ৪০ লক্ষ। সেই অনুপাতে ১০,৩২৩ সংখ্যাটি সারা রাজ্যেই অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছিল। সেখানে বাংলার জনসংখ্যা ১০ কোটিরও বেশি। সেই নিরিখে ২৬ হাজার সংখ্যাটি সারা বাংলায় কতটা এবং কী রকম প্রভাব ফেলবে, তা-ও বিচার্য।
ত্রিপুরার বিজেপির নেতাদের দাবি, তাঁদের রাজ্যে বাম সরকারের পতনে ১০,৩২৩ জনের চাকরি বাতিল যে ভাবে ‘অনুঘটকের ভূমিকা’ নিয়েছিল, বাংলাতেও সেই একই ঘটনা ঘটবে। ত্রিপুরা বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র সুব্রত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বাংলা আর ত্রিপুরার মাটি আলাদা। তবে মৌলিক একটা মিল রয়েছে। তা হল, দুই রাজ্যেই দীর্ঘ বামশাসনের পরে মানুষ পরিবর্তন করেছিলেন। কিন্তু তৃণমূল যে ভাবে দুর্নীতি করেছে, তাতে মানুষের ক্ষোভ হিমালয়সমান জায়গায় পৌঁছেছে। চাকরি বাতিল-সহ যা যা হচ্ছে, তাতে সামনের ভোটে তাদের বিদায় আসন্ন।’’
উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি রাজ্য ত্রিপুরার বাম সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী ভানুলাল সাহা আবার ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলার বিষয়টিকে এক করে দেখতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘‘ত্রিপুরা আর বাংলার বিষয়ের মধ্যে ফারাক রয়েছে। আমাদের রাজ্যে প্রক্রিয়াগত ত্রুটি হয়েছিল। কিন্তু বাংলায় টাকাপয়সার বিনিময়ে নিয়োগ হয়েছে। দুটো এক বিষয় নয়।’’ ত্রিপুরা সিপিএমের প্রথম সারির নেতারা একান্ত আলোচনায় এ-ও বলছেন, শুধু চাকরি বাতিলের জন্য বাম সরকারের পতন হয়নি। দীর্ঘ দিন সরকারে থাকার ফলে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাও কাজ করেছিল। বাংলাতেও তৃণমূল যখন ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে যাবে, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের মাথায় থাকবে ১৫ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। সে দিক থেকে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল কি তৃণমূলের জন্য উদ্বেগের? অনেকের মতে, উদ্বেগ রয়েছে বলেই রায় ঘোষণার অব্যবহিত পরেই শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে তড়িঘড়ি নবান্নে ডেকে পাঠিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সরকারি আমলাদের নিয়ে বৈঠকের পরে সাংবাদিক সম্মেলন করে মমতা জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশ মেনেই তিন মাসের মধ্যে রাজ্য সরকার নতুন নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। সেই সঙ্গে মমতা এ-ও বলেছেন, ‘‘এই মামলায় তো তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীকে (পার্থ চট্টোপাধ্যায়) জেলে রেখে দেওয়া হয়েছে অনেক দিন হয়ে গেল! এক জনের অপরাধে কত জনের শাস্তি হয়?’’
প্রসঙ্গত, গত বছর লোকসভা ভোটের প্রথম দফা হয়ে যাওয়ার পরে কলকাতা হাই কোর্ট ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল করেছিল। সেই নির্দেশের পরেই সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন মমতা স্বয়ং। কিন্তু ভোটের বাক্সে বিপুল কিছু হেরফের হয়নি। বরং ২০১৯ সালের তুলনায় বাংলায় আসন বেড়েছিল তৃণমূলের। তবে রাজনৈতিক মহলের আলোচনায় ত্রিপুরার প্রসঙ্গ আসছে। কারণ, বছর ঘুরলেই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট।