বনগাঁর গোপালনগরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
মতুয়াদের খাসতালুকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাবেশ ঘিরে রাজনৈতিক আগ্রহ ছিল যথেষ্ট। বিশেষ করে গত লোকসভা ভোটে বনগাঁ-সহ মতুয়া অধ্যুষিত কেন্দ্রগুলিতে তৃণমূল পিছিয়ে পড়ার পরে বিধানসভা ভোটের আগে হারানো জমি কতটা ফেরানো যায় মমতার কাছে তা বড় চ্যালেঞ্জ। বুধবার বনগাঁর গোপালনগরে বিশাল সমাবেশ করে তৃণমূলনেত্রী সেই পথে প্রথম পদক্ষেপ করলেন।
মতুয়া আবেগকে ‘মর্যাদা’ দিতে মমতা এতটাই সচেতন ছিলেন যে তাঁর সভা শেষে বনগাঁর বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরও মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকাকে সাধুবাদ দিয়েছেন। তৃণমূলের দাবি, মমতা সর্বদাই মতুয়াদের পাশে। তাঁদের যে ভুল বোঝানো হয়েছিল, আজ ওই সম্প্রদায়ের সবাই তা মানছেন।
ভিড় দেখে খুশি মমতা এ দিন দরাজ হয়েছেন মতুয়াদের দাবিদাওয়া নিয়ে। মতুয়া সম্প্রদায়ের পবিত্র দিন হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিন মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশী তিথিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। মতুয়াদের উন্নয়ন বোর্ডের কথা আগেই ঘোষণা করেছিলেন। মতুয়াদের আরাধ্য হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুরু হয়েছে বলে মমতা জানান। মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশীতে ছুটি ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে সাংসদ শান্তনু বলেন, ‘‘হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিতে ছুটি ঘোষণা ভাল পদক্ষেপ।’’ পাঠ্যসূচিতে হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবনী অন্তর্ভুক্তির কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আরও কিছু সংযোজন করতে হলে বলবেন।’’
আরও পড়ুন: নে হল দিদি আমাদের উপর একটু রেগে গেলেন, বলছেন সোনালিরা
আরও পড়ুন: উপড়ে ফেলেই ছাড়ব, কলকাতায় এসেই মমতাকে নিশানা নড্ডার
গত লোকসভা ভোটে মতুয়ারা মুখ ফেরানোয় এই আসনে হেরেছে তৃণমূল। মতুয়াদের ঠাকুরবাড়ির বধূ তৎকালীন সাংসদ মমতা ঠাকুরকে হারিয়ে সেই বাড়ির ছেলে শান্তনু বিজেপির টিকিটে সাংসদ হন। তবে এ দিনের সভার ভিড়ে অন্তত নতুন বিন্যাসের ইঙ্গিত মিলেছে। সভাস্থল তো বটেই, আশপাশের বাড়ির ছাদ, গাছ কোথাও তিলমাত্র জায়গা ছিল না। ভিড় সামলাতে বনগাঁ-চাকদহ রাজ্য সড়কে জনতাকে বসিয়ে দিতে হয়। মঞ্চ থেকে প্রশ্নোত্তরে জনতার সঙ্গে সরাসরি কথাও বলেন মুখ্যমন্ত্রী।
বনগাঁর এই জমায়েত দেখার পর পাশের জেলা নদিয়ার রানাঘাট লোকসভা আসন নিয়েও রাজনৈতিক মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। কারণ মতুয়া অধ্যুষিত রানাঘাট আসনেও বিজেপির কাছে হেরেছিল তৃণমূল। তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের দাবি, “মতুয়ারা ভালই জানেন মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের জন্য কী করেছেন। তাই লক্ষ লক্ষ মানুষ সভায় এসেছিলেন।’’ তাঁর দাবি, মতুয়া মনে এই বদল ঘটেছে গোটা রাজ্যেই।
মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আশ্বাসেই গত লোকসভা ভোটে তৃণমূলকে কাত করেছিল বিজেপি। কাজ না এগোনোয় বেশ কিছু দিন ধরেই বেসুরো সাংসদ শান্তনু। বিজেপির সঙ্গে শান্তনুর ও মতুয়াদের একাংশের দূরত্ব বাড়ছে বলে যে গুঞ্জন চলছে, তাতে নতুন মাত্রা যোগ করে মমতা এ দিন বলেন, ‘‘আমি মুখ্যমন্ত্রী বলে যাচ্ছি, কোনও কাগজের দরকার নেই, এনআরসি-র দরকার নেই। আপনারা আমাদের দেশের নাগরিক। এটা রাজ্যের বিষয়। এখানে এনআরসি হবে না।” সেই সঙ্গেই সিএএ-র ‘বিপদ’ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘‘এনআরসি, এনপিআর হলে আপনাদের পূর্বপুরুষদের জন্মের প্রমাণপত্র দিতে হবে। কী দেবেন, সেটা বড় কথা নয়। কেন দেবেন? আপনারা এখানে বাস করছেন। বিদ্যুৎ-ফোনের বিল দিচ্ছেন। আপনাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়ছে না? সেটাই তো প্রমাণপত্র। তার বলেই আপনারা নাগরিক।’’ এই বিষয়ে বিজেপির বারাসত সাংগঠনিক জেলার সভাপতি শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘উনি (মমতা) সংবিধান মানেন না। সংবিধান জানেন না। নাগরিকত্ব দেওয়াটা কেন্দ্রের বিষয়। মুখ্যমন্ত্রী মতুয়াদের ভাঁওতা দিচ্ছেন।’’
মমতা এ দিন, “ওরা শুধু হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিভেদ বাধায় না। পরিবারের মধ্যেও বিভেদ তৈরি করে। দেখুন মতুয়াদের ঠাকুরবাড়িতেও ভাঙন ধরিয়ে দিয়েছে।” মতুয়াদের অভাব অভিযোগ দেখার জন্য এ দিন বনগাঁর তৃণমূল নেতা গোপাল শেঠকে দায়িত্ব দেন মমতা।