অবশেষে মুখ খুললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মন্ত্রিসভার সহকর্মী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি নিয়ে অবশেষে মুখ খুললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং জানিয়ে দিলেন, দল এবং সরকারের সঙ্গে ওই ঘটনার কোনও সম্পর্ক নেই। মমতার কথায়, ‘‘আমি মানুষের দল করি। মানুষ যা চাইবে, আমি তা-ই করব। দল বা সরকার এর সঙ্গে রিলেটেড (সম্পর্কযুক্ত) নয়।’’ পাশাপাশিই মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, এত টাকা তোলা হয়েছে, তা তিনি জানতেন না। কারণ, বিষয়টি কেউ তাঁর গোচরে আনেননি। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘এত যে টাকা উঠল, আমি তো জানব! কেউ তো আমায় জানায়নি। কেউ জানালে তখনই তো অ্যাকশন হবে!’’
পার্থ প্রসঙ্গে সরাসরি নাম-না করেও মমতার বক্তব্য, ‘‘কেউ অন্যায় করে থাকলে কোর্ট আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিক। আমার আইন-আদালতের উপর ভরসা আছে।’’ মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘আমি চাই, তিন মাসের মধ্যে বিচার করে দোষীদের শাস্তি দাও। সত্যির বিচার হোক। এই ঘটনা কেউ করতে পারে বলে আমি নিজেও বিশ্বাস করি না। ঘটনা না রটনা— সেটার বিচার হবে। বিচারে আইন যা রায় দেবে, আমাদের দল মেনে নেবে। বিচারে যত চরমই শাস্তি হোক, আমরা কোনও হস্তক্ষেপ করব না। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও আই ডোন্ট মাইন্ড!
মমতার বক্তব্যে স্পষ্ট, পার্থ দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি তাঁকে ছেড়ে কথা বলবেন না। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত তিনি তাড়াহুড়ো করে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাইছেন না। যদিও মমতার বক্তব্যের পর বিরোধী শিবির বলতে শুরু করেছে, তিনি পার্থের উপর ‘দায়’ চাপিয়ে দিচ্ছেন। আবার বিরোধীদের একাংশ বলছে, পার্থকে কাঠগড়ায় তুলে নিজের এবং দলের ‘দায়’ ঝেড়ে ফেললেন মুখ্যমন্ত্রী।
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী যেমন বলেছেন, ‘‘পার্থের দায় মমতাকেই নিতে হবে।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের তির্যক মন্তব্য, ‘‘ভাগ্যিস বলেননি, পার্থকে চিনি না!’’
একই সঙ্গে ওই ঘটনায় তাঁর নাম জড়ানোয় বিরোধী বিজেপি-সিপিএমকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘বিজেপি-সিপিএম টাকার পাহাড় দিয়ে আমার ছবি দিচ্ছে কলকাতা জুড়ে! রাজনীতি না-করলে জিভটা কেটে দিতে পারতাম!’’ একই সঙ্গে তিনি বললেন, ‘‘যে অন্যায় করেছে, তার বিরুদ্ধে যা খুশি করুন। আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না!’’
একই সঙ্গে মমতার বক্তব্য, ‘‘যদি কেউ চোর-ডাকাত হয়, আমি তাকে ছেড়ে কথা বলি না। কিন্তু অযথা আমার গায়ে কালি ছেটালে মনে রাখবেন, আলকাতরা কিন্তু আমার কাছেও আছে। আমি আলকাতরা মাখালে সেটা কিন্তু কোনও ওয়াশিং মেশিনে ধুলেও উঠবে না।’’ মমতা তার আগে বলেন, ‘‘দুর্নীতিকে সমর্থন করা আমার নেশাও নয়। পেশাও নয়। কিন্তু কয়েকটি রাজনৈতিক দলের আচরণে আমি দুঃখিত। মর্মাহত। শোকাহত। আমি প্রাক্তন সাংসদ হিসেবে মাসে এক লক্ষ টাকা করে পেনশন পাই। কিন্তু তা আমি নিই না।’’ তাঁর অর্থের সংস্থান বই লিখে, গানে সুর দিয়ে হয় বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, পার্থের পৃষ্ঠপোষিত পুজোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটি ভিডিয়ো বিরোধী রাজনৈতিক দলের তরফে নেটমাধ্যমে পেশ করা হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, মমতার সঙ্গে একই মঞ্চে পার্থ এবং তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ (ইডির দাবি মোতাবেক) অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কে। সেই প্রসঙ্গটিও সোমবার তাঁর ভাষণে এনেছেন মমতা। বলেছেন, ‘‘আমি কি ভগবান, যে জানব, কে কার বন্ধু! আমি পুজো উদ্বোধনে গিয়েছিলাম। একটা মেয়ে মঞ্চে ছিল। সে নাকি পার্থর বন্ধু! পুজোয় যদি স্টেজে উদ্যোক্তারা কাউকে ডেকে আনে, হোয়াট ক্যান আই ডু!’’
গত ২১ জুলাইয়ের পর সোমবারই মমতা আবার প্রথম প্রকাশ্য কোনও সভামঞ্চে এলেন। তার মধ্যেই ঘটে গিয়েছে পার্থের গ্রেফতারি এবং পার্থের ‘ঘনিষ্ঠ’ (ইডির দাবি অনুযায়ী) মডেল-অভিনেত্রী অর্পিতার বাড়ি থেকে প্রায় ২২ কোটি নগদ টাকা উদ্ধারের ঘটনা। অর্পিতাকেও গ্রেফতার করেছে ইডি। তাঁকে হেফাজতে নিয়ে জেরা করতে চেয়ে আবেদনও করেছে আদালতে।
এই পুরো সময়টাই নীরব ছিলেন মমতা। ফলে দলের নেতাদের একাংশ মনে করছিলেন, সোমবার নজরুল মঞ্চে বঙ্গসম্মান অর্পণের মঞ্চ থেকে মমতা মুখ খুলবেন। খুললেনও। সমস্ত পুরস্কার দেওয়ার পর বলতে ওঠেন মমতা। তখনই তিনি বলেন, ‘‘আমি এখানে উপস্থিত গুণিজনদের অনুমতি নিয়ে কয়েকটা কথা বলতে চাই। ভুল কিছু বললে আমায় মাফ করে দেবেন।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমি কিছু না-বললেও পারতাম। কিন্তু তখন আবার বলা বা লেখা হবে, আমি চুপ করে আছি।’’
মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘‘যে অন্যায় করেছে, তার বিরুদ্ধে যা খুশি করুন। আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না। মনে রাখবেন, আহত সিংহ কিন্তু অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।’’ আবার পাশাপাশিই বলেছেন, ‘‘সকলেই সাধু, এ কথা বলতে পারব না। সাধুর মধ্যেও ভূত আছে। কেউ ভুল করলে সংশোধনেরও সুযোগ দিতে হবে। আমি মিডিয়া ট্রায়াল করব না! বিচারের আগেই কী করে কাউকে দোষী বানিয়ে দেওয়া যায়! বাচ্চার জন্মের আগেই অন্নপ্রাশনের দিন ঠিক হয়ে গেল? কেউ ভুল করতেই পারে। জ্ঞানত ভুল করে থাকলে সেটা অপরাধ। কিন্তু জেনেশুনে আজ পর্যন্ত কোনও অন্যায় আমি করতে দিইনি নিজেকে।’’
মমতার আরও বক্তব্য, ‘‘কেউ কেউ একটা মহিলাঘটিত ব্যাপার নিয়ে কথা বলছেন। আমি ওটা নিয়ে বেশি বলতে চাই না। ওটা বিচারাধীন বিষয়। আমাদের দল অত্যন্ত স্বচ্ছ। আমরা বিত্তবান নেতা চাই না। বিবেকবান নেতা চাই।’’
নজরুল মঞ্চের বক্তৃতায় মমতা বলেছেন, বিজেপি মহারাষ্ট্রের মতো সমস্ত রাজ্যে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে। তাঁর কথায়, ‘‘মহারাষ্ট্রের পর ভাবছে ঝাড়খণ্ড। তার পরে ছত্তীসগঢ়। বাংলায় এসে দ্যাখ না এক বার!’’ সেই প্রসঙ্গেই শুভেন্দু বলেছেন, ‘‘আসলে মহারাষ্ট্রের ঘটনা দেখার পর মুখ্যমন্ত্রী ভয় পাচ্ছেন যে, তাঁর সরকার ভেঙে দেওয়া হবে। অনৈতিক কাজ করলে এবং অনৈতিক শক্তিকে মদত দিলে এমন ভয় হতেই পারে।’’