মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
গত ২৪ নভেম্বর ২০২৩, নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) উদ্দেশে ‘অনুরোধ’ জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ বিধানসভা অধিবেশনে সেই আরএসএসের বিরুদ্ধেই তীব্র আক্রমণ শানালেন মুখ্যমন্ত্রী।
তিন মাস আগে মমতা যা বলেছিলেন, সেই স্বর বা সুরের সঙ্গে বৃহস্পতিবারের বক্তব্যের কোনও মিল ছিল না। যা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে শাসক এবং বিরোধী শিবিরে।
গত নভেম্বরে তৃণমূলের সর্ব স্তরের নেতা-কর্মীদের নিয়ে বিশেষ সাংগঠনিক অধিবেশন করেছিলেন দলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা। যে অধিবেশনে সশরীরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের না যাওয়া, তাঁর ছবি না থাকা নিয়ে তৃণমূলের মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেই সভায় মমতা বলেছিলেন, “আপনারা ধর্ম করুন, আমার কোনও আপত্তি নেই। আমার আপনাদের বিরুদ্ধে কোনও কিছু বলার নেই। কিন্তু দেশের জন্য যে লোকটা সবচেয়ে ক্ষতিকারক, তাঁকে আর সাপোর্ট দেবেন না।” সঙ্ঘের উদ্দেশে মমতা আরও বলেছিলেন, “আপনারা বিভিন্ন সময়ে অনেককে সমর্থন করেছেন। কিন্তু এই লোকটাকে প্লিজ আর সাপোর্ট করবেন না। জগাই আর মাধাই! দেখলেই মনে হয় খেতে আসছে!’’ মমতা কারও নাম করেননি। কিন্তু এটা সহজবোধ্য ছিল যে ‘জগাই-মাধাই’ বলতে তিনি নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহকে বুঝিয়েছিলেন।
বৃহস্পতিবার সেই মমতাই বিধানসভা অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে সন্দেশখালিকাণ্ডে আরএসএসের ঘাড়ে দায় চাপিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘সন্দেশখালিতে শাহজাহানকে ‘টার্গেট’ করে ইডি ঢুকল। সেই নিয়ে গোলমাল করে সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের মধ্যে ঝামেলা লাগানো হচ্ছে। ওখানে আরএসএসের বাসা রয়েছে।’’ মমতা জানান, এমনিতেই ওটা ‘অশান্তিপ্রবণ’ এলাকা। তাঁর কথায়, ‘‘সেখানে মুখে মাস্ক পরে গোলমাল করা হচ্ছে। বহিরাগতরাই সন্দেশখালিতে এত গোলমাল পাকাচ্ছে।’’
তৃণমূল এনডিএ-র শরিক থাকাকালীন সঙ্ঘের নেতাদের সঙ্গে মমতার বোঝাপড়া মন্দ ছিল না বলেই বিজেপির নেতাদের দাবি। এ নিয়ে তৃণমূলকে সমালোচনায় প্রতিনিয়ত বিদ্ধ করে বামেরা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মমতা বিভিন্ন সময়ে সঙ্ঘ নিয়ে বিবিধ মন্তব্য করেছেন। বছর দু’য়েক আগে মমতা একবার নাম না করে আরএসএসের উদ্দেশে বলেছিলাম, ‘‘আগে জানতাম এরা এনজিও-র মতো। চ্যারিটি করে। এখন দেখছি ডে়ঞ্জারাস। বাপ রে বাপ!’’
তিন মাসের মধ্যে সঙ্ঘ সম্পর্কে মমতার স্বরবদল কেন? তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র কুণাল ঘোষের ব্যাখ্যা, ‘‘তখন একরকম প্রেক্ষাপটে কথা বলেছিলেন। এখন বর্তমান প্রেক্ষাপটে কথাটা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এর মধ্যে তাৎপর্য খোঁজার কোনও কারণ নেই।’’ সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘কাক যেমন কোকিলের বাসায় ডিম পাড়ে, তেমন আরএসএসও তৃণমূলের বাসায় ডিম পাড়ে। এ কথা আমি বহু বছর ধরে বলছি। মমতাও কার্যত সেটা মেনে নিয়েছেন।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘সন্দেশখালিতে আরএসএসের বাসা রয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানতেন না?’’
মমতার বৃহস্পতিবারের বক্তব্যের সমালোচনা করেছে সঙ্ঘ। আরএসএসের প্রান্ত প্রচার প্রমুখ বিপ্লব রায় বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নিখোঁজ শেখ শাহজাহানকে আড়াল করতেই আরএসএস সম্পর্কে এই ধরনের কথা বলছেন। ওখানে যে হিন্দু মহিলারা নির্যাতিত হওয়ার কথা বলছেন, তাঁরা তো কেউ সঙ্ঘের নয়। বরং তাঁরা তৃণমূল করেন।’’ বিপ্লবের সংযোজন, ‘‘সঙ্ঘ সমাজনির্মাণের কাজ করে। অশান্তি করা সঙ্ঘের কাজ নয়।’’
রাজনীতির কারবারিদের একাংশের মতে, স্থানীয় রাজনীতির ‘বাধ্যবাধকতা’র কারণে মমতা আরএসএস সম্পর্কে এতটা ‘আগ্রাসী’ মনোভাব দেখিয়ে থাকতে পারেন। তাঁদের বক্তব্য, সন্দেশখালিকাণ্ডে বিজেপি যখন মেরুকরণকে তীব্রতর করতে কোমর বেঁধে নেমেছে, তখন মমতাও আরএসএসকে বিঁধে সংখ্যালঘুদের বার্তা দিতে চেয়েছেন। কারণ, সন্দেশখালি বসিরহাট লোকসভার মধ্যে। যে আর বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে সংখ্যালঘুরা নির্ণায়ক।
১৯৮০ সাল থেকে বসিরহাট লোকসভাটি ছিল সিপিআইয়ের দখলে। ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, মনোরঞ্জন শুর, অজয় চক্রবর্তীরা ছিলেন বসিরহাটের সিপিআই সাংসদ। ২০০৯ সালে সংখ্যালঘু প্রার্থী দিয়ে বসিরহাট বামেদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল তৃণমূল। সাংসদ হয়েছিলেন হাজি নুরুল ইসলাম। ২০১৪ সালে তৃণমূল প্রার্থী করে জিতিয়ে এনেছিল সদ্যপ্রয়াত ইদ্রিস আলিকে। ২০১৯ সালে বসিরহাট ধরে রাখতে অভিনেত্রী নুসরত জাহানকে প্রার্থী করে জিতিয়ে এনেছিলেন মমতা। ফলে সংখ্যালঘু প্রার্থী এবং ভোট যে ওই কেন্দ্রে তৃণমূলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা প্রার্থী চয়ন ও বদলের ধারাবাহিকতাই বলে দিচ্ছে বলে অনেকের দাবি।