মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
রাজ্যে পরপর কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছিলেন শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের একাংশ। এ বার নিচু তলার পুলিশ এবং সরকারি আধিকারিকদের একাংশ দুর্নীতি, অন্যায়ে জড়িত বলে মন্তব্য করলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! তাঁর আঙুল মূলত পুলিশ ও ভূমি দফতরের দিকে। ওই দুই দফতরই রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। সেই তথ্য স্মরণ করিয়ে বিরোধীদের দাবি, দুর্নীতির কথা মেনে নিলে দফতরের মন্ত্রী হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীরই দায় স্বীকার করা উচিত।
নবান্নে বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বুঝিয়ে দিয়েছেন, পুলিশের নানা কাজেই তিনি সন্তুষ্ট নন। রাজ্য পুলিশের বিভিন্ন শাখাকে শক্তিশালী করার দায়িত্ব ডিজি রাজীব কুমারের উপরে ছেড়েছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, সিআইডি-কে ঢেলে সাজা হবে। তার প্রস্তাবও তৈরির করার নির্দেশ ডিজি-কে দিয়েছেন তিনি। রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং পুলিশের ভূমিকা নিয়ে গত কয়েক দিনে শাসক দলের নেতারা যেমন প্রশ্ন তুলেছেন, তার পাশাপাশিই উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পুলিশ দফতরের দায়িত্ব তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়ার প্রস্তাবও ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে শাসক শিবিরের কোনও কোনও মহল থেকে। এর পরে পুলিশের একাংশের দিকে মুখ্যমন্ত্রীর তোপ এবং সেই বিভাগের ব্যবস্থায় বদল আনার ঘোষণা শাসক শিবিরের অভ্যন্তরীণ সমীকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত কি না, সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেছেন, “রাজনৈতিক নেতাদের নামে লোকে বদনাম করে বেশি। পাঁচ টাকা খেলে ৫০০ টাকার কথা বলে, বলে দেয় চোর! রাজনৈতিক নেতারা টাকা খাওয়ার আগে ১০ বার ভাবে, মানুষের টাকা খাওয়া কি উচিত! তাদের একটা দায়বদ্ধতাও থাকে।” এর সঙ্গেই ডিজি-র উদ্দেশে তাঁর সংযোজন, “তুমি হয়তো চেষ্টা করো। কিন্তু স্থানীয় স্তরে পুলিশের একাংশ সহযোগিতা করছে না। নিচু তলার কিছু অফিসার, কর্মী যারা এই সরকারকে ভালবাসে না, পুলিশেরও কিছু লোক টাকা খেয়ে বালি, কয়লা, সিমেন্ট চুরিতে মদত দিচ্ছে। কেন ভূমি দফতর বসে আছে? কিছু করছে না!”
ডিজি-র উদ্দেশে মমতার নির্দেশ, এসটিএফ এবং দুর্নীতি দমন শাখাকে শক্তিশালী করতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “সিআইডি-তে রদবদল করব পুরোটা। প্রস্তাব দেবেন ডিজি। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করতে হবে। কেউ বাধা দিলে শুনব না। আমি নিজের কথাও শুনব না! আমি যদি নিজেকে ক্ষমা না করি, তা হলে তোমরা কাকে ভয় পাচ্ছো?’’ প্রশাসনিক মহলের একাংশের প্রশ্ন, পুলিশের অন্দরে কি কোনও গোষ্ঠী সক্রিয় হওয়ার গন্ধ পাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী? পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ কি ভিন্ন কোনও ভরকেন্দ্রের দিকে ঝুঁকছে?
পুলিশ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে প্রত্যাশিত ভাবেই হাতিয়ার করছে বিরোধীরা। রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র তথা রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘শাসক নেত্রী মমতা এই সব কথা বলছেন গুলিয়ে দেওয়ার জন্য। আপনার দলের নেতাদের কথা ছেড়ে দিন। আপনার আশেপাশে থাকা আইএএস-আইপিএস’দের সম্পত্তির হিসেব নিন। শুধু নিচু তলার পুলিশ-কর্মীদের উপরে দোষ দিলে হবে! তৃণমূলের নির্দেশ ছাড়া কারও কিছু করার ক্ষমতা আছে?’’ সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘পাচারকারী কারা এবং পাচারকারীদের রক্ষাকর্তা যে পুলিশ, সবাই জানে। রাজ্যে ১৩ বছর পুলিশমন্ত্রী থেকে এখন মুখ্যমন্ত্রী জানলেন? উপরের সবাইকে বাঁচিয়ে নিচু তলাকে দোষ! ওঁর বলা উচিত ছিল, পুলিশমন্ত্রী হিসেবে দায় আমার! নাকি এগুলো আসলে নিজের ঘরেই কাউকে ঘুরিয়ে বার্তা দিচ্ছেন? বোঝাতে চাইছেন, কে কী করছে, সব উনি জানেন?’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘তবে তাতেও পুলিশমন্ত্রীর দায় লাঘব হয় না।’’ প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র সৌম্য আইচ রায়েরও দাবি, ‘‘পুলিশমন্ত্রী তথা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিজের দফতরের লোকেদের চোর বলছেন! ওঁর বিন্দুমাত্র লজ্জা-শরম থাকলে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করে চলে যাওয়া উচিত!’’
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ফের অভিযোগ করেছেন, পাথর-বালির জায়গাগুলি দরপত্রের মাধ্যমে নির্ধারণ করার নীতি নিয়েছিল রাজ্য সরকার। তার পরেও অবৈধ খাদান বা বালি-কয়লা-পাথর পাচার অব্যহত রয়েছে। এই সূত্রেই তিনি বলেছেন, “সিআইএসএফ টাকা খেলেও আমাদের লোকেদের ধরার অধিকার আছে। চুরি হলে বলবে, কয়লা চুরি করছে তৃণমূল, আর চুরি হবে সিআইএসএফ এবং পুলিশের একাংশ টাকা খাওয়ায়, এটা বরদাস্ত করব না। রাজনৈতিক দলের লোক খেলেও কলার চেপে ধরো আইনত। জেলে পাঠাও!” মমতার সংযোজন, “আমার দরকার নেই এক পয়সা। দরকার হলে নির্বাচন করার জন্য লোকের কাছে আঁচল পেতে টাকা নেব। সরকারি কাজে বা কারও কাছ থেকে একটা টাকাও নিয়েছি, কেউ বলতে পারবে না! অন্য কেউ নিলে কেন ছাড়া পাবে? আইন প্রত্যেকের জন্য সমান হওয়া উচিত। ম্যানেজ করা যাবে না। আমি বাঁচাব না!”