—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
রেলের ‘টাইম টেবল’ মানে কখন ট্রেন ছাড়বে তা জানার জন্য। কিন্তু ইদানীং হাওড়া স্টেশনের যাত্রীদের কাছে ‘টাইম টেবল’ ট্রেন কতটা দেরিতে ছাড়ছে সেটা বোঝার জন্যই। কারণ কেউ জানেন না। রেলের কাছে যাত্রীদের তরফে অভিযোগ জানানোর পরেও কোনও সদুত্তর মেলেনি। যাত্রীদের অভিযোগ, বেশ কয়েক বার হাওড়ার ডিআরএম এবং ডিওএম-কে ব্যাক্তিগত ভাবে এবং তাঁদের দফতরে অভিযোগ জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। তাই মনে মনে ‘গজগজ’ করে রেলের বাপবাপান্ত করা ছাড়া কোনও উপায় নেই বলেই মেনে নিয়েছেন হাওড়া থেকে বর্ধমান মেন ও কর্ড শাখার যাত্রীরা। একই অবস্থা কাটোয়া কিংবা তারকেশ্বর শাখার ট্রেনের ক্ষেত্রেও। এ সব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বোঝা গেল যাত্রীরা রাগ প্রকাশের চেয়ে রসিকতা করছেন বেশি।
দিনের বেলা যতটা না সমস্যা, তার কয়েক গুণ বেশি সন্ধ্যার পরে। এই সময়ে সব চেয়ে বেশি যাত্রী হাওড়া থেকে ট্রেন ধরেন। আবার সন্ধ্যার পর থেকেই সব চেয়ে বেশি সংখ্যায় আপ ট্রেন ছাড়ে হাওড়া থেকে। এক একটা সময়ে এমন হচ্ছে যে, একসঙ্গে তিন-চারটি ট্রেনের যাত্রীরা ভিড় করছেন স্টেশনের প্রবেশ পথে। সকলেরই চোখ উপরের দিকে ঝোলানো বোর্ডের দিকে। সেখানেই তো আলো দিয়ে লেখা হয় কোন প্লাটফর্ম থেকে কোন ট্রেন ছাড়বে। সেটা জানা গেলেও ভিড় ছড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেই বোর্ডে আলোর রেখা সহজে না আসাতেই আঁধার নামছে যাত্রীদের মনে।
সন্ধ্যার পরে যাত্রী মানেই অফিস ফেরত মানুষ। আবার ব্যবসা বা অন্য কাজে যাঁরা কলকাতায় আসেন তাঁরাও দিনের শেষ ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরতে চান। অনেকের কাছেই মালপত্র থাকে। কিন্তু দিনের পর দিন এই সব মানুষের কষ্ট চলছেই। রেলের পক্ষে যেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কোনও চেষ্টাই নেই। নিত্যযাত্রী সুখেন চৌধুরী থাকেন ভদ্রেশ্বরে। অফিস সেরে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছান সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ। লক্ষ্য থাকে ৭টা ১০ মিনিটের বর্ধমান মেন ধরার। কিন্তু ইদানীং সেটা আর হচ্ছে না। সুখেন বলেন, ‘‘আমি তো একই সময়ে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছই। কিন্তু রোজই অনেক আগের কোনও ট্রেন পাচ্ছি। তা বলে আগে পৌঁছে যাচ্ছি তা নয়। হয় তো ৬টা ৪৫-এর ব্যান্ডেল লোকাল পেলাম। কিন্তু সেটা ছাড়ল সাড়ে ৭টা নাগাদ।’’
এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই। তারকেশ্বরের নিত্যযাত্রী শ্যামল আদকের বক্তব্য, ‘‘খুব যে অসুবিধা হচ্ছে তা নয়। বাড়ি ঠিক সময়েই পৌঁছচ্ছি। তবে রাত ৮টা ৪০ মিনিটের ট্রেন ধরতে এসে সেই সময়েই পাচ্ছি ৮টা ৫-এর তারকেশ্বর লোকাল। খালি সেটা মারাত্মক ভিড় নিয়ে যাচ্ছে। আসলে আমার মতো অনেকেরই তো ওই ট্রেনটায় ওঠার কথাই নয়।’’ এ নিয়ে আরও মজার কথা বললেন চন্দননগরের বাসিন্দা মৌমিতা নস্কর। প্রতি দিনই অফিস সেরে তিনি ৭টা ২৫ মিনিটের গ্যালপিং কাটোয়া লোকাল ধরেন। এই ট্রেনটি হাওড়া ছেড়ে সরাসরি চন্দননগরে গিয়ে থামে। মৌমিতা বলেন, ‘‘রোজই ওই ট্রেনটা ধরার চেষ্টা করি। কখনও মিস করিনি তা নয়। তবে ইদানীং আর মিস হচ্ছে না। গত সোমবারই কাজ মেটাতে দেরি হয়ে যাওয়ায় বুঝে গিয়েছিলাম কাটোয়া ধরা যাবে না। ধীরে সুস্থে ৮টা নাগাদ পৌঁছে দেখি আমার জন্যই যেন কাটোয়া দাঁড়িয়ে। কী আনন্দ যে হয়েছিল!’’
মাঝপথ থেকে স্টেশন থেকে যাঁরা ট্রেন ধরেন তাঁদের আবার অন্য একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। এখন কোন ট্রেন কোথায় রয়েছে জানার জন্য ‘হোয়্যার ইজ় মাই ট্রেন’ অ্যাপ খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু এই অ্যাপটি তখনই ট্রেনের অবস্থান জানাতে পারে যখন ট্রেনটি হাওড়া থেকে ছেড়েছে। কারণ, যাত্রীদের ফোনের জিপিএস এবং টাওয়ার লোকেশনের উপরেই নির্ভরশীল এই অ্যাপটি। ফলে ট্রেন কোথায় রয়েছে, কত ক্ষণে স্টেশনে আসবে তা বোঝাও যাচ্ছে না হাওড়া না ছাড়লে।
এ তো গেল সন্ধ্যার আপ ট্রেনের কথা। ওই সময়ে এবং দিনের অন্য সময়ে ডাউন ট্রেনের অবস্থা তথৈবচ। ট্রেনে ট্রেনে বাদাম, ডালমুট ইত্যাদি বিক্রি করলেও হকার মনোরঞ্জন দাশের অন্য খ্যাতি রয়েছে হাওড়া বর্ধমান মেন শাখায়। ছন্দ মিলিয়ে কথা বলতে ওস্তাদ মনোরঞ্জন রেলের এই পরিস্থিতি নিয়ে সুকুমার রায়ের ‘হ য ব র ল’ মনে করিয়ে দিলেন। স্বভাবসুলভ অঙ্গভঙ্গি করে বললেন, ‘‘অবস্থা পুরো গেছো দাদার মতো। ধরুন, আমি কাটোয়া লোকাল ধরতে চাই। আগে হিসেব করে দেখতে হবে, ট্রেনটা কোথায় কোথায় নেই, তার পর হিসেব করে দেখতে হবে, ট্রেনটা কোথায় কোথায় থাকতে পারে, তার পর দেখতে হবে, ট্রেন এখন কোথায় আছে। তার পর দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছব, তখন ট্রেন কোথায় থাকবে।’’
দিনের পর দিন এমন চলায় যাত্রীদের অবস্থাও যেন— হাজার অভিযোগের পরে ‘হাতে রইল পেন্সিল’। আর রেল কী বলছে? পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক পুরনো কথাই আবার বললেন। কৌশিক মিত্র আনন্দবাজার অনলাইকে বলেন, ‘‘রক্ষাণাবেক্ষণের বিভিন্ন কাজের জন্য অনেক সময়েই ট্রেন সঠিক সময়ে চালানো যে যাচ্ছে না এটা ঠিক। যাত্রীদের অসুবিধাও বুঝছি। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার কারণে রক্ষণাবেক্ষণের কাজটাও জরুরি। আশা করি দ্রুত স্বাভাবিক হবে পরিষেবা।’’