‘মিমিক্রি’ একটা শিল্প এবং তিনি এক জন শিল্পী। উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়কে নকল করে তাঁর কথাবার্তা এবং ভাবভঙ্গি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হতে এমনই মন্তব্য করেছেন তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, তিনি কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেননি। আবার আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নাম টেনেছেন শ্রীরামপুরের সাংসদ। বলেছেন, ২০১৪ থেকে ’১৯ সাল পর্যন্ত মোদী লোকসভায় অনেক বার ‘মিমিক্রি’ করেছেন। আর তিনি তো নকল করেছেন সংসদের বাইরে।
মিমিক্রিতে কল্যাণ ভালই। আর বিতর্কে জড়ানোও কল্যাণের কাছে নতুন কোনও বিষয় নয়। বরং আলটপকা মন্তব্য করে নিত্যনতুন বিতর্কে জড়ানো কল্যাণের অভ্যাস বলা যায়। কখনও তাঁর আক্রমণের মুখে পড়েন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কখনও শুভেন্দু অধিকারী তো কখনও জগদীপ ধনখড়।
তৃণমূলের বলিয়ে কইয়ে সাংসদ হিসাবে কল্যাণের পরিচিতি। পেশায় আইনজীবী কল্যাণের ঘনিষ্ঠরা বলেন, সাংসদকে বোঝা কঠিন। তিনি এই হাসাহাসি করেন তো ওই রেগে যান। আর মাঝেমধ্যে এমন কিছু বলে ফেলেন, যাতে দলকেও অস্বস্তিতে পড়তে হয়। মঙ্গলবারের ‘শিল্প’ তো তারই প্রতিফলন।
চলতি বছরেই কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগে কলকাতার রাজভবনের সামনে ধর্না দিয়েছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই ধর্নামঞ্চে বক্তৃতা করার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিশানা করেন শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ। সেখানে মোদীকে কটাক্ষ করে চটুল হিন্দি গানের লাইন ধরে কল্যাণের ‘খিঁচ মেরি ফটো খিঁচ’ নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়। সমাজমাধ্যমে চকিতে ভাইরাল হয়ে যায় সেই ভিডিয়ো।
জগদীপ ধনখড়কে কল্যাণের কটাক্ষ একেবারে নতুন কিছু নয়। ধনখড় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল থাকাকালীন তৃণমূল সাংসদ বিভিন্ন সময়ে তাঁকে নিশানা করেছেন। তার মধ্যে একটি ছিল বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডার ডায়মন্ড হারবার সফরের সময় গন্ডগোলের ঘটনা। বিধানসভা ভোটের সময়। তখন রাজ্য বনাম রাজ্যপালের নিত্যনতুন সংঘাত হচ্ছে। তৃণমূল ভবনে সাংবাদিক বৈঠক করে আইনজীবী কল্যাণ বলে দেন, ‘‘ভারতীয় সংবিধানের রচয়িতারা ভাবতে পারেননি যে, ধনখড়ের মতো লোক গভর্নর হতে পারেন। বিআর অম্বেডকর জানলে বোধ হয় ওই পোস্টটিই রাখতেন না।’’
বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পর্কে কল্যাণের একটি মন্তব্য ঘিরে তো তীব্র শোরগোল হয় রাজ্য রাজনীতিতে। সেটা ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়। সেই প্রথম বার শ্রীরামপুর কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের টিকিট পেয়েছেন কল্যাণ। প্রচারে বেরিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তথা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে উদ্দেশ্য করে কল্যাণ বলেন, ‘‘উনি শিল্প বোঝেন না। শিক্ষা বোঝেন না। কিচ্ছু বোঝেন না। শুধু নন্দনে বসে স্কচ-হুইস্কি। আর দু’-চারটে সামনে মহিলা থাকবে, এর বাইরে কিছু বোঝেন না।’’
পরে অবশ্য একাধিক জায়গায় কল্যাণ বলেছেন তাঁর ওই মন্তব্য করা উচিত হয়নি। মাসকয়েক আগে বুদ্ধদেব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তখন কল্যাণ বলেছিলেন, ‘‘একজন রাজনীতিবিদ হিসাবে ওঁর একটা স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তো রয়েছেই। উনি অসুস্থ। ওঁর সুস্থতা কামনা করি।’’
বুদ্ধতেই শেষ নয়। কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ দীপা দাশমুন্সিকেও নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন কল্যাণ। এক বার তিনি বলেছিলেন, তিনটি রুটি হলে দুটি খান, একটি কপালে লাগিয়ে নেন দীপা। কংগ্রেস নেত্রীর বড় টিপ পরার অভ্যাস নিয়ে এই টিপ্পনী করেন কল্যাণ। এ নিয়েও শোরগোল হয়েছিল।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে শুভেন্দু অধিকারীর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে তখন জল্পনা তুঙ্গে। আচমকা তাঁকে তীব্র আক্রমণ করেন কল্যাণ। একটি জনসভা থেকে কল্যাণ শুভেন্দুর নাম না করে বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে গাছের তলায় বড় হয়েছিস। চারটে মন্ত্রিত্ব পেয়েছিস। চার খানা চেয়ারে আছিস। কত পেট্রল পাম্প করেছিস! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না থাকলে তো মিউনিসিপ্যালিটিতে আলু বিক্রি করতিস রে, আলু বিক্রি করতিস!’’
তারই মধ্যে হঠাৎ শোনা যায় শুভেন্দু তৃণমূলে থাকবেন। তখন তাঁকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করতে শোনা যায় কল্যাণকে। কিন্তু শেষমেশ শুভেন্দুর তৃণমূলত্যাগ এবং বিজেপিতে যোগদানের পর কল্যাণ দাবি করেন, তিনি জানতেন এমনটাই হবে। কল্যাণ মন্তব্য করেন, ‘‘আজ থেকে তো নয়, এক বছর আগে থেকে বিজেপির সঙ্গে যোগসাজশ চলছিল শুভেন্দুর। এত দিন যা চলছিল সব খেলা। আমি অনেক আগে থেকেই জানতাম, দিদিমণিকেও (মমতা) বলেছিলাম। উনি বিশ্বাস করেননি। এখন বুঝতে পারছেন আমার বলা সব কথাই কতটা সত্যি।’’
কল্যাণ সঙ্গীতপ্রেমী। সুরের তোয়াক্কা না করেই মাইক হাতে মঞ্চে গান শুরু করেন তিনি। শুভেন্দুর মতো রাজ্যের আর এক প্রাক্তন মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিতে চলে গিয়েছিলেন। পরে তৃণমূলে ফিরেও আসেন। তাঁকে নিয়ে কালীপুজোর অনুষ্ঠানে ‘গঙ্গা আমার মা’ গানের প্যারোডি গান সাংসদ কল্যাণ। তাঁকে গাইতে শোনা যায়, ‘‘আমি দুই নদীতেই নাচি…মানে তৃণমূলে নাচছে, বিজেপিতেও নাচছে। এক বার চলে যাব মা বলে, একবার চলে যাব মোদীর কাছে… দুই চোখে দুই জলের ধারা মেঘনা-যমুনা। মমতাদি এক কোণে মোদীজি আর এক কোণে।”
বেশ কয়েক বছর আগে আরও একটি গানের মঞ্চে দেখা যায় কল্যাণকে। নিজের লোকসভা কেন্দ্রে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ‘নদীয়াঁ সে দরিয়া’ গাইতে গাইতে কোমর দোলান। তা নিয়ে জোর চর্চা হয়।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে বাঁকুড়া গিয়েছিলেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে সাংবাদিক বৈঠকে জেলার এক তৃণমূলনেত্রীর গালে হাত দিয়ে অঙ্গভঙ্গি করতে দেখা যায় তৃণমূল সাংসদকে। কটাক্ষ করে বিরোধীরা। তবে সাংসদ তা গায়ে মাখেননি।
এ হেন কল্যাণের বিরুদ্ধে দলের অন্দরেই কয়েক মাস আগে বিক্ষোভ হয়েছে। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব এবং ‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দলের একাংশের রোষে পড়েন কল্যাণ। তাঁর বিরুদ্ধে সমাজমাধ্যমে তুমুল প্রচার দেখা যায়। যার নেপথ্যে ছিল তৃণমূলের একটি অংশই। আবার কলকাতার ভবানীপুরের যদুবাবুর বাজারে তৃণমূল কর্মীদেরই একাংশ কল্যাণের কুশপুতুল পুড়িয়েছিল। স্লোগান ওঠে, ‘‘মাতাল তোমায় জানতে হবে, আগামীকে মানতে হবে।’’ অভিযোগ, নির্দিষ্ট কয়েকজন মহিলার থেকে অনুগ্রহ নিয়ে তাঁদের বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন কল্যাণ। এই সবটাই তিনি করেছেন সাংসদপদের ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে।
ফি বছর দুর্গাপুজোয় অন্য মেজাজে কল্যাণকে দেখতে পাওয়া যায়। সন্ধিপুজোয় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তৃণমূল সাংসদ। দুর্গাপ্রতিমার সামনে ‘মা-মা’ বলে হাউ হাউ করে কাঁদেন তিনি। মন্ত্রপাঠ করেন। পুজোয় সক্রিয় ভাবে অংশ নেন। বস্তুত, শ্রীরামপুর গান্ধী ময়দানের ৫ এবং ৬-এর পল্লির পুজো সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুজো বলেই পরিচিত।
২০০৬ সালে প্রথম বার বিধায়ক হন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৯ থেকে টানা শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদ। মমতাভক্ত এই সাংসদের মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গি থেকে কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা হয় বার বার। ইউপিএ আমলে প্রবীণ সাংসদদের দিকে তেড়ে যাওয়া থেকে এনডিএ জমানায় উপরাষ্ট্রপতিকে নকল করে ‘শিল্প’, কল্যাণ আছেন কল্যাণেই।