অধরা ক্ষতিপূরণ কিংবা জীবন-সুরক্ষা সংক্রান্ত সাহায্য। প্রতীকী ছবি।
রাজ্য সরকারের মৎস্য সমবায় সংস্থা ‘বেন ফিশ’-এর প্রায় ৭০ ফুট উঁচু জলাধার সাফ করতে উঠছিলেন দু’জন। হঠাৎ বাঁশ ভেঙে এক জন পড়েন খানিকটা নীচে থাকা অন্য জনের উপরে। এর পরে দু’জনেই সরাসরি মাটিতে। যিনি উপরে ছিলেন, হাসপাতালে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। অন্য জনের পেট ফেটে ভিতরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেরিয়ে আসে। মালাইচাকি ঘুরে যায়। হাতের হাড় ভেঙে দু’টুকরো হয়ে যায়!
প্রায় ২৭ দিন হাসপাতালে কাটানো, নারায়ণ ঘোষ নামে সেই শ্রমিককে কোনও মতে বাঁচান চিকিৎসকেরা। কিন্তু কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তিনি। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ওই ব্যক্তির এমন পরিস্থিতির কারণে পড়া ছেড়ে তড়িঘড়ি কাজে ঢুকতে হয় তাঁর মেয়েকে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার পিয়ালির বাসিন্দা নারায়ণ ফোনে বলেন, ‘‘আর কাজ করতে পারি না। সেই সময়ে সংবাদমাধ্যমের চাপে আমার চিকিৎসার খরচ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর বেশি কিছুই পাইনি। ক্ষতিপূরণ তো ছেড়েই দিন, আমি বেঁচে আছি কি না, সেই খোঁজটুকুও নেয়নি ঠিকাদার সংস্থা।’’
কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, নির্মাণ বা অন্য যে কোনও ধরনের কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়া শ্রমিকদের এমনই পরিণতি হয় বলে অভিযোগ। মেলে না ক্ষতিপূরণ বা জীবন-সুরক্ষা সংক্রান্ত সাহায্য। কখনও ঠিকাদার সংস্থা, কখনও বা প্রধান যে সংস্থার অধীনে কাজ চলছিল, তাদের দোরে দোরে সাহায্যের আশায় ঘুরে বেড়াতে হয় শ্রমিকের পরিবারকে। সম্প্রতি এ জে সি বসু উড়ালপুলে ঝাঁট দেওয়ার সময়ে গাড়ির ধাক্কায় এক মহিলার মৃত্যুর ঘটনাতেও একই অভিযোগ উঠেছে। হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশনার্সের (এইচআরবিসি) অধীনে থাকা ওই উড়ালপুলে ঝাঁট দেওয়ার জন্য দরপত্র ডেকে একটি সংস্থাকে কাজ দিয়েছিল এইচআরবিসি। ওই সংস্থার অধীনেই কাজ করতেন মহিলা।
শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তেরা জানাচ্ছেন, এমনটা হওয়ার কথা নয়। দেশের চুক্তি শ্রমিক আইন (১৯৭০) অনুযায়ী, মৃত্যু বা দুর্ঘটনার এক বছরের মধ্যে ক্ষতিপূরণ অথবা চিকিৎসার খরচ পেতে মৃতের পরিবার আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে। বিধি অনুযায়ী, যদি কোনও ঠিকাদার সংস্থা দুর্ঘটনার পরে চিকিৎসার খরচ বা অন্য ক্ষতিপূরণ না দেয়, তা হলে মুখ্য নিয়োগকারী (অর্থাৎ, দরপত্র ডেকেছিল যে সরকারি সংস্থা) ঠিকাদার সংস্থার মাধ্যমে শ্রমিককে টাকা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। এক শ্রমিক আন্দোলনকারীর বক্তব্য, ‘‘দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে ঠিকাদার সংস্থাকে চুক্তি শ্রমিক আইন (১৯৭০) মেনে লাইসেন্স নিতে হয়। লাইসেন্সের শর্ত হল, ২০ জন বা তার বেশি শ্রমিক থাকলেই এমপ্লয়িজ় প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু করতে হবে। ১০ জন বা তার বেশি শ্রমিক থাকলেই ইএসআই ও গ্র্যাচুইটি দিতে হবে। লাইসেন্সের এই সব শর্তের ভিত্তিতে মুখ্য নিয়োগকারী সংস্থাই পারে ঠিকাদার সংস্থাকে চেপে ধরতে।’’ শ্রমিক সংগঠন সিটু-র রাজ্য কমিটির সম্পাদক দেবাঞ্জন চক্রবর্তী যদিও বললেন, ‘‘চেপে ধরার উদ্যোগ দেখা যায় না। শ্রমিকের স্বার্থ কাটা পড়ে সরকারি সমঝোতায়। নিয়মে আছে, ৩০০ জন বা তার বেশি শ্রমিক যেখানে কাজ করছেন, সেখানে এক জন সেফটি সুপারভাইজ়ার রাখতে হবে। ৫০০ জন বা তার বেশি শ্রমিক কাজ করলে সেফটি অফিসার রাখা বাধ্যতামূলক। নিরাপত্তার এমন নিয়মও মানা হয় না।’’
এ বিষয়ে সরকারের ভূমিকাই বা কী? শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটককে বার বার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। উত্তর দেননি টেক্সট মেসেজের। শ্রম দফতরের এক অতিরিক্ত লেবার কমিশনার বলেন, ‘‘সরকারি শ্রমিক কল্যাণমূলক তহবিল থাকে। শ্রমিক নিজের নাম লিখিয়ে রাখলে সেগুলি পাওয়া যায়। তবে শ্রমিকদের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতা থাকে না। ঠিকাদার সংস্থাগুলিও এ ব্যাপারে জোর দেয় না।’’ শ্রমিক আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের দায়িত্ব পালন করে না। সরকারও চুপ থাকে। এক শ্রমিক বলেন, ‘‘আরও এক সমস্যা হল, রাষ্ট্র মানুষের পরিচিতি নির্দিষ্ট করে তার বাসস্থান দিয়ে— বুথ-ভিত্তিক ভোটদান, বসবাস-ভিত্তিক জমির দলিল, ঠিকানা-ভিত্তিক রেশন কার্ড বা পঞ্চায়েত-ভিত্তিক জব কার্ড দিয়ে। সরকার যেন ধরেই নেয়, শ্রমিকের বাঁচা-মরা একই জায়গায়। কিন্তু বাস্তবে কেউ কাজের সূত্রে সপ্তাহে পাঁচ দিন শহরে থাকেন, কেউ বা বছরে চার-পাঁচ বার অন্য জেলায় বা রাজ্যে কাজ করতে যান, কেউ বিভিন্ন বছর বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে কাজ করেন। তা ছাড়া, এক রেশন কার্ডের দেশব্যাপী ব্যবহার চালু হয়নি। লকডাউন দেখিয়েছে শ্রমিকদের আসল দুর্দশা। যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সুরাহা হয়নি।’’